বান্দরবান শহরের আর্মি পাড়া এলাকায় স্বাধীনতার সময় থেকে বসবাস করে আসছেন ব্যবসায়ী নুরুজ্জামান। তার ঘরের পাশ দিয়েই প্রবাহিত শহরের পানি নিষ্কাশনের প্রধান খাল ম্যাকছি ঝিরি স্থানীয়রা অনেকেই মিক্সি ঝিরি হিসেবেই চিনে। বাড়ি নির্মাণের পর থেকে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারলেও মূলত ৯০ এর দশকের পর জনবসতি বাড়তে থাকায় ওই ঝিরিটির অধিকাংশ এলাকা দখল হতে থাকে। বর্তমান সময়ে অবস্থা আরো শোচনীয়।
ম্যাকছি ঝিরি এখন এত ছোট হয়ে গেছে যে এটি দিয়ে পানি নিষ্কাশিত হয় না। ফলে বর্ষা মৌসুমে ঝিরিতে পানি আটকে জলাবদ্ধতার মুখোমুখি হতে হয় বাসিন্দা নুরুজ্জামানকে। তার মত ওই এলাকার আরও শত শত পরিবারের এখন একই অবস্থা। বর্তমানে এমন অবস্থা হয়েছে যে এক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই ঝিরিটির দুপাড় উপচে পড়ে পানি। শত শত ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়ে যায়। বৃষ্টি দীর্ঘায়িত হলে শহরের আর্মি পাড়া, মেম্বার পাড়া, ওয়াপদা ব্রিজ, শেরে বাংলা নগর, বাস স্টেশন, অফিসার্স ক্লাব, কাশেমপাড়া বনানী সুমিল এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়।
এলাকাগুলো বান্দরবান শহরের বড় একটি অংশ। এসব এলাকায় জনবসতিও সবচেয়ে বেশি। দেশের বিভিন্ন জায়গার নিম্ন আয়ের লোকজন ও নদীভাঙা এলাকার গরিব অসহায় মানুষ শহরের এসব এলাকায় বসবাস করে। ফলে জলাবদ্ধতা ও বন্যার সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এসব এলাকার লোকজন। ম্যাকছি ঝিরি শহরের পূর্ব দিকে স্টেডিয়াম এলাকা থেকে শুরু হয়ে বয়ে গেছে আর্মিপাড়া, মেম্বার পাড়া হয়ে ওয়াপদা ব্রিজ, অফিসার্স ক্লাব সর্বশেষ বনানী সমিল এলাকা দিয়ে একটি সাঙ্গু নদীতে গিয়ে মিশেছে।
এই খালটির সঙ্গে আরো কয়েকটি পাহাড়ি ঝিরি মিলিত হয়েছে। এরমধ্যে লাল ব্রিজ এলাকার ঝিরি ও রুমা বাস স্টেশনের কাছে চান্দাবাজপাড়া এলাকার হাতিভাঙা ঝিরি। স্থানীয় পাহাড়ি বাঙালিরা এটিকে ম্যাকছি ঝিরি হিসেবেই চিনে। বর্তমানে এই ঝিরিগুলোর দুপাড়ে কয়েক লক্ষ মানুষ বসবাস করে। দখলের কবলে পড়ে দিনদিন সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে শহরের পানি নিষ্কাশনের এই প্রধান মাধ্যমটি। এটি এখন বান্দরবানবাসীর দুঃখ হিসেবে পরিচিত। পানি উন্নয়ন বোর্ডে ও নদী রক্ষা কমিশনের হিসেবে এটি বান্দরবান শহরের লাইফ লাইন হিসেবে পরিচিত। এই ঝিরিটি দখলের মুখে পড়ে একদিকে যেমন সংকীর্ণ হয়ে গেছে অপরদিকে ময়লা আবর্জনায় ভরাট হয়ে পানি নিষ্কাশনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে ও দূষণও করছে।
কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এই ঝিরিটি : সমতল এলাকায় যারা থাকেন তারা অনেকেই মনে করেন পাহাড়ি এলাকায় আবার কীভাবে বন্যা হয়। কিন্তু অনেকেই জানেন না বর্ষা মৌসুমে বান্দরবান শহরে পানি নিষ্কাশিত হতে না পেরে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এই জলাবদ্ধতা অনেক সময় সপ্তাহব্যাপী দীর্ঘায়িত হয়। নদী রক্ষা কমিশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন বান্দরবান শহরের পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম ম্যাকছি খাল। শহরের জনবসতি বাড়তে থাকায় পয়ঃনিষ্কাশনের অন্যতম মাধ্যমও এটি।
এছাড়া এই ঝিরিতে আরো বেশ কয়েকটি উপশাখা যোগ হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে সব পানি নদীতে গড়ায় এই ঝিরি দিয়ে। ১.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ঝিরিটির শহরের পানি ও ময়লা আবর্জনা বনানী সমিল এলাকায় গিয়ে এটি স্লুইস গেটের মাধ্যমে সাঙ্গু নদীতে পড়ছে প্রতিদিন। স্লুইসগেটটি গত প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। বর্তমানে বর্ষা মৌসুমে সাঙ্গু নদীর পানি উপচে এই ঝিরিটি দিয়ে উল্টো শহরে প্রবেশ করে। ফলে শহরের নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।
গবেষক ও অভিজ্ঞরা জানিয়েছেন, সাঙ্গু নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে নদীর পানির সীমারেখার উচ্চতা ম্যাকছি ঝিরির চাইতে বেশি হয়ে যায়। ফলে সহজেই নদীর পানি শহরে ঢুকে পড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। নদীর পানির উচ্চতা না কমা পর্যন্ত শহরের জলাবদ্ধতার পানি ম্যাকছি ঝিরি দিয়ে নিষ্কাশিত হয় না। অনেক সময় বর্ষা দীর্ঘায়িত হলে শহরের জলাবদ্ধতাও নদীর পানির উচ্চতার উপর নির্ভর করে দীর্ঘায়িত হয়। অন্যদিকে দখলের কারণে ঝিরি সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ায় পানির ধারণ ক্ষমতাও দিন দিন কমছে। অন্যদিকে ময়লা আবর্জনা ও অপরিকল্পিত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণে নদী ও শহরে দূষণ ছড়াচ্ছে ঝিরিটি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন করতে গেলে নদী শাসনের পাশাপাশি ম্যাকছি ঝিরির উন্নয়ন করতে হবে।
কারা ঝিরির দখলদার : নদী রক্ষা কমিশন, জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব মতে ম্যাকছি ঝিরির দুপাশে ৯৮টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। সম্প্রতি জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার উদ্যোগে ম্যাকছি ঝিরির খনন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। শহরের এলজিইডি অফিস হতে শুরু করে আর্মিপাড়া মেম্বারপাড়া ওয়াপদা ব্রিজ এলাকায় খনন কাজ চলে। অনেক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। ফলে গত বর্ষা মৌসুমে সহজেই শহরের পানি নদীতে প্রবাহিত হয়ে যায়।
তবে স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেছেন বিভিন্ন প্রভাবশালী লোকজনদের অবৈধ দখলের কারণে অনেক জায়গায় উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি। এছাড়া খনন কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পর পুনরায় ময়লা আবর্জনায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে ঝিরিটি। প্রতিরক্ষা কমিশন ও জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে ম্যাকছি ঝিরির প্রস্তাবিত ৫৭০০ ফুট খনন কার্যক্রমের মধ্যে ২৫০০ ফুট পর্যন্ত খনন হয়েছে। এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে শহরের মেম্বার পাড়া থেকে শুরু করে ওয়াপদা ব্রিজ অফিসার্স ক্লাব এলাকা বনানী সমীর এলাকায় ঝিরির দুপাশ দখল হয়ে গেছে। বাস স্টেশন ও অফিসার্স ক্লাব এলাকায় হোটেল হিল ভিউ ও হোটেল হিলটন ভবনের একাংশ ঝিরি দখল করে গড়ে উঠেছে।
এছাড়া নতুন বাস স্টেশন এলাকায় হাতি ভাঙা পাড়ার ঝিরিটির অধিকাংশ দখল হয়ে গেছে। প্রভাবশালী ঠিকাদার, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি স্থাপনাও গড়ে উঠেছে ঝিরির দুপাশে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী অরূপ চক্রবর্তী জানিয়েছেন জেলা প্রশাসন, পৌরসভা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের যৌথ উদ্যোগে অবৈধ দখলদার ও স্থাপনা নির্ধারণের কাজ চলছে। এটি সম্পন্ন হওয়ার পর প্রশাসনের সিদ্ধান্তমতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্থানীয়রা যা বলছেন : বান্দরবানের সাবেক পৌর কাউন্সিলর কামরুল ইসলাম বাচ্চু ও মো. হারুন জানিয়েছেন ছোট্ট শহরে জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বেশিরভাগ শহরের কাছে পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় লোকজন ঝিরি খাল নদীর তীর দখল করে ঘরবাড়ি তৈরি করছে। এতে করে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ফলে জলাবদ্ধতা যেমন তৈরি হচ্ছে তেমনি দূষণ বাড়ছে। অল্প বৃষ্টিতেই তলিয়ে যাচ্ছে শহরের নিম্নাঞ্চল। এখন থেকেই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে শহরের অবস্থা আরো খারাপ হবে। জলাবদ্ধতা বন্যায় সাধারণ মানুষ কষ্ট পাবে।
সাবেক পৌর মেয়র জাভেদ রেজা জানিয়েছেন তার সময়ে শহরের পানি নিষ্কাশনে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো হয়। উন্নত ও পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা না হলে শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব নয় বলে মনে করেন সাবেক এই মেয়র। এদিকে বান্দরবান ও লামা পৌরসভার পানি নিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে প্রকল্প নেওয়া হয়। বান্দরবান শহরের পৌর এলাকার অধিকাংশ জায়গায় এখন নতুন নতুন ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। তবে এতে করে জলাবদ্ধতা নিরসন হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন স্থানীয়রা।
পূর্বকোণ/ইব