দুই পাশে তার পাহাড়ে হেলান দিয়ে যেন প্রেয়সীর বিছিয়ে রাখা আঁচলের মতো সবুজ আচ্ছাদন। আর মাঝখান দিয়ে ঘোলা জল নিয়ে পাহাড় থেকে পাহাড়ের দ্বারে ঘুরে ঘুরে বয়ে চলেছে সে স্রোতধারা। এর মাঝেই পাহাড়ের খাঁজে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর ছোট ছোট পাড়া বা গ্রাম। আকাশও যেন মিতালি পাতিয়েছে এই পাহাড় সবুজ আর জলধারার সঙ্গে। তাই তো এ জলধারার প্রতিটি বাঁক হয়ে উঠেছে ছবির মতো সুন্দর আর অনেক বেশি নির্মল। এ জলধারা হলো দেশের পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চল বা বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার অন্যতম প্রধান নদী মাতামুহুরী।
পাহাড়ি মানুষের কাছে এ নদী শুধু জলজ আশীর্বাদ নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাদের জীবনচিত্রের শত শত স্মৃতি, আনন্দ বেদনার কাব্য। রয়েছে পাহাড়ি বানে ঘর-বাড়ি ভেসে যাওয়ার বিষাদ। আছে স্বজন হারানোর দুঃখও। তবু মাতামুহুরী ঘিরে তারা আবার স্বপ্ন দেখে, ঘর বাঁধে, অবগাহন করে তার জলে। কারণ এর নামের সঙ্গেই রয়েছে মাতা বা মায়ের যোগ। সত্যিকার অর্থেই এ নদী যেন মা হয়ে আগলে রাখে তার দুই পারে বসবাস করা সন্তানদের। বিশেষ করে বান্দরবানের লামা, আলীকদম ও কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মানুষের লাইফলাইন এ নদী।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, ১৪৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ১৫৪ মিটার গড় প্রস্থের সর্পিলাকার এ নদীর উৎপত্তিস্থল বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার পাহাড় থেকে। কারো মতে লামার মাইভার পর্বতে মাতামুহুরী নদীর উৎপত্তি। মারমা ভাষায় মাতামুহুরী নদীর নাম মোরেই খ্যোং বা মেরিখ্যাইং। মোরেই বা মেরি শব্দের অর্থ মাতামুহুরী আর খ্যাং বা খ্যাইং শব্দের অর্থ নদী।
আলীকদম প্রেসক্লাব সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমদও দাবি করেছেন, মাতামুহুরীর উৎপত্তি আলীকদম উপজেলার বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার সীমান্তের পাহাড়ি এলাকা থেকে। এর উৎপত্তিস্থলে নদীটি যেখানে গিয়ে তার নাম হারিয়েছে সরেজমিন সেখানে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। স্থানটির নাম দোছড়ি-ফাত্তারা। দোছড়ি ও ফাত্তারা পৃথক দু’টি খাল বা উপনদী। এ দু’টি খালের সংযোগস্থল থেকেই মাতামুহুরী নদীর শুরু। এ স্থানটি ইংরেজি ওয়াই অক্ষরের মতো। দোছাড়ি-ফাত্তারার নিচের দিকে মাতামুহুরীর পাড় ঘেঁষে একটি উপত্যকায় রয়েছে পাহাড়ভাঙা নামে মুরুং পাড়া। বলা হয় সুউচ্চ পাহাড় থেকে একসময় এ উপত্যকায় একটি ঢাল ভেঙে পড়ে ছিল। সে জন্য এ পাড়ার নাম পাহাড়ভাঙা।
একইভাবে ভিন্ন আরেকটি মত হলো, দোছড়ি খাল যেখান থেকে সৃষ্টি হয়েছে সেটিই হবে মাতামুহুরীর উৎসমুখ। কারণ নদীর সংজ্ঞা অনুযায়ী সেটিই হওয়ার কথা। দোছড়ি খালটির উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ‘ওয়ালিতং’ পাহাড়। পাহাড়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই। মাতামুহুরী নদীর নামকরণের একটি ইতিহাসও আছে। জনশ্রুতি রয়েছে, এই নদী নাকি কোন একটি একক উৎস বা নির্দিষ্ট জলপ্রপাত থেকে সৃষ্টি নয়। বরং মাতৃস্তন সদৃশ বিভিন্ন পর্বতের গা থেকে চুয়ে চুয়ে পড়া পানি দ্বারাই সৃষ্টি এ নদীর। সে জন্যই এর নাম মাতামুহুরী। মাতা মানে মা আর মুহুরী শব্দের অর্থ অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে জলপড়া।
পূর্বকোণ/ইব