চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০১ এপ্রিল, ২০২৫

সর্বশেষ:

হুমকিতে সাঙ্গু রিজার্ভ ফরেস্ট

বাড়ছে জনবসতি, কমছে বনাঞ্চল ও পশু-পাখি

মিনারুল হক, বান্দরবান

১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ১২:১৯ অপরাহ্ণ

বান্দরবানের সাঙ্গু রিজার্ভ ফরেস্ট। মিয়ানমার সীমান্ত ঘেঁষা দেশের দক্ষিণ পূর্বের গভীর এক বনাঞ্চল। ১৮৮০ সালে সংরক্ষিত ঘোষিত এই বনাঞ্চল দেশের একমাত্র কুমারী বনাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এই বনাঞ্চলে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৪৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৯ প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং ১১ প্রজাতির বিরল পাখির অস্তিত্ব রয়েছে।

 

 

২০১০ সালে বাংলাদেশের বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সাঙ্গু মাতামুহুরী বনাঞ্চলের অংশ নিয়ে সাঙ্গু মাতামুহুরী অভয়ারণ্য সৃষ্টি করা হয়। এই অভয়ারণ্যের আয়তন ২৩৩১.৯৮ হেক্টর (৫৭৬০ একর)। বর্তমানে এই প্রাকৃতিক বনে যেমন বাড়ছে জনবসতি তেমনি অবাধে কাঠ পাচার, বন্যপ্রাণী শিকারীদের উৎপাত ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে এ অভয়ারণ্য। ৯০ এর দশকের পর বর্তমানে এই সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ২১টি পাড়া গড়ে উঠেছে। রয়েছে দুই শতাধিক পরিবার। গড়ে উঠছে নানা স্থাপনা। ফলে দিন দিন কমে আসছে এই রিজার্ভ ফরেস্টের আয়তন। হারিয়ে যাচ্ছে বিপন্ন প্রায় নানা প্রজাতির পশুপাখি গাছপালা।

 

কেন গুরুত্বপূর্ণ এই বনাঞ্চল : সাঙ্গু-মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনাঞ্চল দেশের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বান্দরবান পার্বত্য জেলার থানচি উপজেলায় অবস্থিত। এটি ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্য হটস্পটের অংশ। ১৮৮০ সালে সাঙ্গু-মাতামুহুরী বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর আয়তন প্রায় ৭৪,০০০ হেক্টর। এটি পার্বত্য অঞ্চলের সর্বপ্রথম সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত বনাঞ্চল, যা দেশে একমাত্র কুমারী (ভার্জিন) বনাঞ্চল হিসেবেও পরিচিত। এই বনাঞ্চলের মধ্যে রয়েছে শঙ্খ বা সাঙ্গু নদীর উৎপত্তিস্থল। সাঙ্গু সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে রয়েছে সাঙ্গু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। সাঙ্গু ও মাতামুহুরী বনাঞ্চলের অভয়ারণ্য সরকার কর্তৃক ঘোষিত দেশের মোট ২৩টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের মধ্যে ৯ম বৃহত্তম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং দেশে চিহ্নিত ৪০টি সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে আয়তনের দিক থেকে এটি ১৬তম। তাছাড়াও, আন্তর্জাতিক সংস্থা বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক স্বীকৃত দেশের ২০টি গুরুত্বপূর্ণ পাখি ও জীববৈচিত্র্য এলাকার ইমফরটেন্ট বার্ড এন্ড বায়োডায়ভারসিটি এরিয়াস (আইবিএস) মধ্যে সাঙ্গু-মাতামুহুরী অন্যতম।

 

উল্লেখ্য, প্রথম থেকেই সাঙ্গু বনাঞ্চলে মাতামুহুরী বনাঞ্চলের চেয়ে বেশি উদ্ভিদ বৈচিত্র্য ছিল। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এ বন অনেক গভীর এবং এখানে অনেক শতবর্ষী গাছ ও বড় বড় বাঁশ রয়েছে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১১-২০১৫ সালে ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলাইয়েন্স কর্তৃক পরিচালিত জরিপে সাঙ্গু বনাঞ্চলকে দেশের সবচেয়ে বেশি প্রাণবৈচিত্র্যের আধার এবং এখানে বিশ্বের অনেক বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে মর্মে বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়। জরিপে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৪৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৯ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ১১ প্রজাতির বিরল পাখির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। যার মধ্যে বন গয়াল বা গাউর, সোনালী বিড়াল, মরমর বিড়াল, লামচিতা, চিতাবাঘ, বাঘ, সম্বর, মার্বেলকেট, বন্যকুকুর, লেঙ্গুর, সূর্য ভালুক, কালো ভালুক, ময়ূর, বৃহৎ আকৃতির চার প্রজাতির কচ্ছপ রয়েছে।

 

সাঙ্গু ও কাছাকাছি এলাকায় ২০০ এর অধিক প্রজাতির পাখি থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। ২০০০ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেনশন অব নেচার (আইইউসিএন) এর লাল তালিকার শ্রেণিবিন্ন্যাস অনুসারে জরিপে পাওয়া সব বন্যপ্রাণীর মধ্যে ৩% মহাবিপন্ন, ১০% বিপন্ন ও ১৭% মহাসংকটাপন্ন বলে জানানো হয়েছে (ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলাইয়েন্স, ২০১৬)। সাঙ্গু-মাতামুহুরী বনাঞ্চলে দেশের অন্যতম মহাবিপন্ন প্রাণী বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব রয়েছে (ডিপার্টমেন্ট অব এনভাইরনমেন্ট-২০১৫), (ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলাইয়েন্স, ২০১৬)। এক সময়ে দেশের বিভিন্ন বনাঞ্চলে বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব থাকলেও এখন শুধুমাত্র সুন্দরবনেই এগুলোকে বেশি দেখা যায়। পার্বত্য অঞ্চলের কাচালং-সাজেক ও সাঙ্গু-মাতামুহুরী সবুজ বনের উপত্যকায় বেঙ্গল টাইগারের বিচরণের খবর রয়েছে। তাই এই বনাঞ্চল বেঙ্গল টাইগার পুনরূদ্ধারের উপযোগী বনভূমি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে (ডিপার্টমেন্ট অব এনভায়রনমেন্ট-২০১৫)।

 

বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যটি একসময় বিলাসবহুল বহুতল চিরহরিৎ বনে আচ্ছাদিত ছিল। তবে বসতির কারণে এসব এলাকার গাছপালা কমে গেছে। তারপরও এটি প্রাকৃতিক সম্পদে বেশ সমৃদ্ধ। এবং উদ্ভিদ বৈচিত্র্য উল্লেখযোগ্য। সাঙ্গু মাতামুহুরীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কাঠের প্রজাতি হল জারুল, গামার, গর্জন, চাপালিশ, টুন, কোরোই, সিভিট, চম্পা, সিমুল, চান্দুল, ইত্যাদি যেগুলি বিশাল আকারে বেড়ে উঠত। বেশিরভাগ গাছই চিরসবুজ ধরনের, যেখানে সবচেয়ে উঁচু গাছের বেশিরভাগই পর্ণমোচী এবং আধা-পর্ণমোচী। দেশের গুরুত্বপূর্ণ দুটি পাহাড়ি নদী সাঙ্গু ও মাতামুহুরী এ রিজার্ভ ফরেস্ট থেকেই উৎপত্তি। এছাড়া আরো বহু ঝিরি ঝর্ণার উৎপত্তি এই রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে।

 

যেভাবে ধ্বংস হচ্ছে এই বনাঞ্চল : ২০১১-২০১৫ সালে পরিচালিত জরিপে সাঙ্গু বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের জন্য সাঙ্গু বনাঞ্চলে বসতি স্থাপন, জুম চাষ ও চোরাশিকারের পাশাপাশি ঋতুভিত্তিক বন সম্পদ আহরণের কথা বলা হয়েছিল (ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন এলাইয়েন্স, ২০১৬)।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট