কক্সবাজারে খুলনার সাবেক কাউন্সিলর গোলাম রাব্বানী টিপু গুলিতে খুন হয় গত ৯ জানুয়ারি। টিপু খুনের পরিকল্পনা করা হয় ঘটনার আরো দুইমাস আগে। খুনের ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী খুলনার দৌলতপুরের রিয়াজ। খুনের পুরো পরিকল্পনায় ছিল ১২ জন।
ঋতু নামের এক তরুণীর হানি ট্র্যাপে পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে খুনের শিকার হন টিপু। খুনে ব্যবহৃত পিস্তল ও পাঁচ রাউন্ড গুলি সরবরাহ করে পূর্ব বাংলা চরমপন্থীদলের প্রয়াত নেতা হাজি শহীদের বডিগার্ড রিপন। টিপুকে খুব কাছ থেকে গুলি করে শহীদের ভাতিজা শেখ শাহরিয়ার ইসলাম। ২০১৭ সালে চরমপন্থী নেতা শহীদকে খুন করেছিল টিপু। টিপুও চরমপন্থী দলের নেতা ছিলেন। কক্সবাজার আসা যাওয়ার খরচ বাবদ শাহরিয়ারকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিল টিপুর প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থী মিল্লাত গাজী।
হত্যায় জড়িতদের সবাইকে টিপু বিভিন্ন মামলায় জেলে পাঠিয়েছিল যাদের সবার বাড়ি খুলনার দৌলতপুরে। মিথ্যা মামলায় একের পর জেল কাটার ক্ষোভ থেকে পরিকল্পিতভাবে হানি ট্র্যাপে ফেলে খুন করা হয় টিপুকে। টিপু হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে র্যাব দুইজন ও পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এরমধ্যে গ্রেপ্তার ঋতু ও গোলাম রসুল কক্সবাজার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আসাদ উদ্দিন মো. আসিফ এবং শেখ শাহরিয়ার ইসলাম পাপ্পু সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিট্রেট আখতার জাবেদের আদালতে গত বুধবার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তিনজনে পুরো হত্যার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন বিজ্ঞ আদালতে। বাকী দুইজন হলেন, মেজবাহ উদ্দিন ভুট্টু ও শেখ হাসান ইফতেখার চালু।
কক্সবাজার থানার ওসি মো. ইলিয়াস খান জানান, গ্রেপ্তার পাঁচজনের মধ্যে তিনজন গত বুধবার বিজ্ঞ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। হত্যার পুরো পরিকল্পনায় ছিল ১২ জন। তারা হলেন ঋতু, শেখ শাহরিয়ার, গোলাম রসুল, রিয়াজ, সানি, মেহেদী, মিল্লাত গাজি, কামরান, সাব্বির, কামাল, রিপন ও রায়হান।
শেখ শাহরিয়ার ইসলাম: সাবেক কাউন্সিল টিপুকে কাছ থেকে পিস্তল দিয়ে গুলি করেন খুলনার দৌলতপুরের জামাল শেখের ছেলে শেখ শাহরিয়ার ইসলাম পাপ্পু। জবানবন্দিতে তিনি জানান, এক বছর আগে তিনি বিয়ে করেছেন। গোলাম রাব্বানী টিপু দৌলতপুর চার নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর ছিলেন। দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ুয়া শাহরিয়ার ২০১৮ সালের আগে তিন বছর চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করেন। ২০২০ সালে টিপুর ব্যবসায়ী পার্টনার ইকবাল সরোয়ার হত্যা মামলায় আসামি হয়ে ১৩ মাস কারাভোগ করেন। জামিনে বের হবার পর আরেকটি হত্যা মামলায় আসামি করে দেয় টিপু। ঐ মামলায় সাড়ে চারমাস জেল কাটে।
স্থানীয় পুলিশের সাথে টিপুর বেশ সখ্যতা ছিল। জামিনে বের হবার পর বিয়ে করেন। বিয়ের দুই মাসের মাথায় আরেকটি হত্যাচেষ্টা মামলায় ফের গ্রেপ্তার হয়ে চারমাস জেল কাটে। ২০২৪ সালের ১৮ এপ্রিল জামিনে বের হয়ে এলাকার ফুফাতো ভাইয়ের সাথে জমি বেচাকেনার কাজ করছিল। তার চাচা চরমপন্থী দলের নেতা শহীদকে ২০১৭ সালে টিপু খুন করে। টিপু ও তার চাচা চরমপন্থী নেতা কামরুলের অনুসারী ছিল। তাদের মধ্যে গ্রুপিং ছিল। একের পর এক মামলা দিলেও ক্ষমতায় থাকায় টিপুকে কিছুই করতে পারছিলোন শাহরিয়ার।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা করে। বিষয়টি বন্ধু রিয়াজের সাথে আলোচনা করে। কারণ রিয়াজকেও বিভিন্ন মামলায় জেল কাটায় টিপু। টিপু নারীলোভী ছিল। রিয়াজ তার বাড়ির পাশের ঋতুকে দিয়ে টিপুর কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। টিপু একসেপ্ট করে। ঋতুকে টিপুর সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর পরামর্শ দেয় তারা। এরমধ্যে ঋতুকে গত ২৯ ডিসেম্বর কক্সবাজার যাবার প্রস্তাব দেয় টিপু। বিষয়টি জানার পর ঋতুকে টিপুর সাথে কক্সবাজার যাবার কথা বলে তারা। এ সময় কক্সবাজারে টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা করে রিয়াজ।
শাহরিয়ার জবানবন্দিতে বলেন, টিপুর সাথে ৮ জানুয়ারি কক্সবাজার যাবার তারিখ ঠিক করে ঋতু। বিষয়টি টিপুর প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থী মিল্লাত গাজীর সাথে আলাপ করি। মিল্লাত তখন বলে তোমরা পারবা নাকি আমি লোক দেব। আমি বলি পারবো। আমার প্রয়াত চাচাকে শহীদের বাডিগার্ড রিপনের মাধ্যমে রায়হান নামে একজনের কাছ থেকে একটি পিস্তল ও পাঁচ রাউন্ড গুলি নিই। ২৯ ডিসেম্বরের পর হত্যার পরিকল্পনার বিষয়টি সাব্বির, কামরান ও গোলাম রসুলকে বলি। মেহেদী ও সানি নামে আরো দুইজনকে দলে ভেড়ানো হয়। কারণ সবাইকে টিপু বিভিন্ন মামলায় কারাগারে পাঠিয়েছিল।
শাহরিয়ার বলেন, মিল্লাত গাজী আমাদেরকে কক্সবাজারে হোটলে কক্স কুইনে রুম ঠিক করে দেয়। ১০ হাজার টাকাও দেয়। গোলাম রসুল আমাদের আগেই কক্সবাজার চলে যায় ঘটনাস্থল রেকি করতে। ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিন বাসে ৯ জানুয়ারি সকালে সানি, মেহেদী ও সাব্বিরসহ কক্সবাজার পৌঁছি। আমরা সবাই এক হোটেলেই ছিলাম। ওই দিন সকালে আমাদের আগে ঋতুকে নিয়ে কক্সবাজার পৌঁছায় টিপু। তারা গোল্ডেন হিল হোটেলে উঠেছিল। এরমধ্যে রিয়াজও কক্সবাজার চলে আসে। তার সাথে ঋতুর সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল।
ওইদিন (৯ জানুয়ারি) সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার সময় ঋতু ও টিপু তাদের হোটেল থেকে বিচের দিকে আসছিল।
আগে থেকে সানি, মেহেদী ও গোলাম রসুল তাদের অনুসরণ করছিল। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার সময় টিপু ও ঋতু বিচে আসার বিষয়টি ফোনে জানায় রিয়াজ। আমার কোমরে গুলিভর্তি পিস্তল ছিল। তারা বিচে কিটকট ছাতার নীচে বসে গল্প করছিল। রাত আটটার দিকে ঋতু ও টিপু হোটেলের দিকে যাচ্ছিল। টিপু ফোনে কথা বলছিল। হোটেল সিগাল পার হবার আাগেই আমি মাথার পিছনে পিস্তল দিয়ে গুলি করলে টিপু মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এরপর আমরা হোটেলে এসে চার রাউন্ড গুলিসহ পিস্তলটি বাথরুমের ছাদে রেখে রাত নয়টায় রিল্যাক্স বাসে উঠে ঢাকা চলে যাই। রিয়াজ খুলনা এবং আমরা মৌলভীবাজার চলে যাই।
গোলাম রসুল: খুলনার দৌলতপুরের হায়দার সরদার অদুদের ছেলে গোলাম রসুল জবানবন্দিতে বলেন, টিপুর দেয়া মামলা আমি আটমাস ২০ দিন জেলে ছিলাম। তার কারণে বাসায় ঘুমাতে পারতামনা। একই এলাকার রিয়াজ, শাহরিয়ার, কামরান, শেখ, সানি সবাই মিলে সরকার পতনের আগে টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা করি। কিন্ত তার দুইজন গানম্যান থাকায় পারিনি। সরকার পতনের পর আমর হত্যার মিশনে নামি। একদিন রিয়াজ বলল টিপু যেহেতু নারীতে অসক্ত। তার জন্য একটি মেয়ে ঠিক করা হয়েছে-তার বান্ধবী ঋতু।
ফেসবুকে টিপুর সাথে পরিচয় হয় ঋতুর। প্রতিদিন টিপুর সাথে কথা বলতো ঋতু। প্রায় দুইমাসের প্রেমের অভিনয় করার পর ঋতুকে কক্সবাজার যেতে প্রস্তাব দেয় টিপু। ঘটনর আগের দিন রাতে আলাদা আলাদা বাসে কক্সবাজার যা টিপু ও ঋতু। এর আগে আমি কক্সবাজার এসে পুরো এলাকা রেকি করি। ৯ জানুয়ারি সকালে টিপু ও ঋতু কক্সবাজার পৌঁছায়। তাদেরকে আমরা অনুসরণ করছিলাম। ঋতুর সাথে রিয়াজের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। ওইদিন সন্ধ্যায় টিপুকে গুলি করে হত্যা করে শেখ শাহরিয়ার।
জবানবন্দিতে ঋতু জানায়, রিয়াজ তার এলাকার বড় ভাই। ২০১৮ সালে ক্রসফায়ারে তার স্বামী মারা যায়। রিয়াজের পরামর্শে টিপুর সাথে ফেসবুকে পরিচিত হয়। পরে মুঠোফোনে প্রতিদিন কথা হতো। এক পর্যায়ে টিপু তাকে কক্সবাজার যাবার প্রস্তাব দেয়। টিপুর কথামতো হোটেল গোল্ডেন হিলে উঠি। রিয়াজ, গোলাম রসুল সবাই আগে থেকেই কক্সবাজার ছিল। টিপুর সাথে ইফতেখার চালু নামে এক বন্ধু ছিল। সন্ধ্যায় টিপু ও আমি বিচে যায়। সবকিছু রিয়াজকে ম্যাসেজ দিয়ে জানাচ্ছিলাম। সন্ধ্যায় আমরা বিচ দিয়ে হাঁটছিলাম। রিয়াজসহ অন্যরা আমাদের অনুসরণ করছিল তা জানতাম। এরমধ্যে হঠাৎ করে গুলি শব্দ শুনি। পরে একটি রিকশা নিয়ে বাস কাউন্টারে চলে যাই। রিল্যাক্স বাসে করে আমরা ঢাকায় যায়। কক্সবাজারে আমরা পুরো পরিকল্পনায় আটজন ছিলাম। পরে শাহরিয়ারের বাবার বন্ধুর সিলেটের বাসায় চলে যাই।
পূর্বকোণ/ইব