চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৬ মে, ২০২৪

বাঁশখালী বেড়িবাঁধ ভেঙে লণ্ডভণ্ড

অনুপম কুমার অভি, বাঁশখালী

২৯ এপ্রিল, ২০২৪ | ৫:২৪ অপরাহ্ণ

‘দেড় শতাধিক পরিবার নিয়ে বসতি ছিল হাজারো মানুষের। দইজ্যা (সাগর) আমাদের বসতঘর, জায়গা-জমি, পুকুরসহ গিলে খেয়েছে। তারপরও স্থায়ী বেড়িবাঁধ হয়নি।’ কথাগুলো বলেন প্রেমাশিয়া গ্রামের ইমাম শরীফ।

 

৫৭ বছর বয়সী ইমাম শরীফ বলেন, ১৯৯১ সালে ভয়াল ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে এই গ্রামে ৬ শতাধিক মানুষ ও কয়েক হাজার গবাদি পশু মারা গেছে। তারপরও এখনো স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি।

 

বাঁশখালী উপকূলীয় ছনুয়া, গণ্ডামারা, বাহারছড়া, খানখানাবাদ, শীলকূপ, সাধনপুরে কিছু অংশে জোয়ারের পানি ঢুকে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়। এছাড়া লক্ষাধিক গবাদি পশু মারা যায়। হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। তারপরও এখনো স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মিত হয়নি সাগর উপকূলে।

 

২০১৫ সালে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ১ম পর্যায়ে ২৫১ কোটি ২৯ লাখ টাকার প্রকল্প নেয়। পরবর্তীতে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৯৩ কোটি ৬০ লাখ টাকায়। ২০২২ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। অথচ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালে। শুধু প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বেড়েছে বার বার। তাই প্রকল্পটিকে ‘পাউবোর টাকা ও সময়খেকো’ প্রকল্প বলা হয়। বর্তমানে বাঁধের বিভিন্ন স্থানে দেবে গেছে। ভেঙে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছে। অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ডের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী শীবেন্দু খাস্তগীরের বাড়ি বাঁশখালীতে।

 

ছনুয়া ইউনিয়নের করিম জান পাড়ার আরেফ মদিনা খাতুন (৬২) বলেন, ছনুয়ার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ৯টি পাড়ায় ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এখনো মানুষের জান-মাল রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি।
সরেজমিনে দেখা যায়, ছনুয়া ইউনিয়নের ছেমটখালী, খুদুকখালী, ছোট ছনুয়া, চেলবন এলাকা এখনো অরক্ষিত। ছনুয়া জেটিঘাট এলাকায় (নৌ-ক্যাম্প) সিসি ব্লক বসানো হলেও তা দেবে গেছে। এলোমেলোভাবে পড়ে রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ রক্ষার ব্লকগুলো। শীলকূপ ইউনিয়নের মনকিচর এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ গ-ামারা খাটখালি এলাকায় জলকদর খাল কিনার দিয়ে ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। সাধনপুরের বৈলগাঁও জেলে পাড়ার পরিবারেরগুলো ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। খানখানাবাদ ইউনিয়নের প্রেমাশিয়া ও কদম রসুল এলাকায় নবনির্মিত বাঁধে ধসে পড়া সিসি ব্লকগুলো আরো ধসে গিয়ে দিনদিন বড় আকারে ফাটল দেখা দিয়েছে। চৌধুরীঘাট এলাকায় বেড়িবাঁধের বিভিন্ন অংশে ধস দেখা দিয়েছে।

 

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রকল্পটি পদে পদে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও গাফিলতির কারণে কাজ টেকসই হয়নি। বাঁধের গোড়া থেকে বালুমিশ্রিত মাটি নিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও সাগরের নোনাপানি ও নোনাপানির বালু দিয়ে ব্লক বানানো হয়েছে। ট্রাস্কফোর্সের তদন্তেও অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছিল। কাজের মান নিয়ে ট্রাস্কফোর্স কমিটি ও বুয়েটে একাধিকবার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অনেক ব্লক বাতিলও করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, মূল ঠিকাদার থেকে উপ-ঠিকাদারির মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ করেছে সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিরা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীদের যোগসাজশে নিম্নমানের ব্লক ও বাঁধ নির্মাণ করা হয়-হচ্ছে।

 

স্থানীয়রা বলেন, খানখানাবাদ এলাকায় নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর পরই ধসে পড়েছে। বালুমিশ্রিত মাটি দিয়ে বাঁধ নির্মাণ ও ব্লক বসানোর কারণে বাঁধ দেবে গেছে।

 

৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নুরুল আলম জানান, হাসান আলী সিকদার পাড়া করিম জান পাড়া, টেক পাড়া, ওয়াজখাতুন পাড়া, হাস পাড়া, সর্দ্দার পাড়া, কালা চান্দ পাড়া, মর্জিনা পাড়া সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই এলাকার ৩টি ওয়ার্ড এখানো অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী হওয়ায় এই এলাকার মানুষরা ঝুঁকিতে বসবাস করে।

 

সাগরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা আবদুস ছত্তার চৌধুরী, ফারুক আহমদ, নুরুল হক বলেন, ‘স্থায়ী বেড়িবাঁধ কখন হবে একমাত্র আল্লাহ-ই জানেন। তারা বলেন, গত বছরও কদমরসুল এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে।

 

ছনুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হারুনুর রশিদ বলেন, ছনুয়া উপকূলীয় এলাকায় অরক্ষিত বেড়িবাঁধের অংশে স্থায়ীভাবে ব্লক বসানোর জন্য অনেকবার আবেদন করা হয়েছে। ছোট ছনুয়া, সেলবন, খুদুকখালী, ছেমটখালী এলাকায় ২৫ হাজার মানুষ ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে।

 

বাঁশখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী অনুপম পাল বলেন, বাঁশখালী উপকূলীয় সমুদ্র উপকূলে ৬টি ইউনিয়নের স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডে প্রকল্প জমা দেওয়া হয়েছে।

 

বাঁশখালীতে বেড়িবাঁধ নির্মাণে ৫৮৮ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এতে রয়েছে বাহারছড়া ইউনিয়নে তিন প্যাকেজে এক হাজার মিটার বাঁধ। খানখানাবাদে চার প্যাকেজে ১৩১০ মিটার, ছনুয়া ইউনিয়নে আট প্যাকেজে ২৮শ মিটার, সাধনপুরে দুই প্যাকেজে ১১শ মিটার, মোহনায় পুরোনো বাঁধ শক্তিশালীকরণে ১৩ মিটার। বাহারছড়া, খানখানাবাদ ও ছনুয়া ইউনিয়নের সাগরতীর এবং সাধনপুর ও মোহনায় সাঙ্গু নদীর তীর ভাঙনরোধে কাজ করা হবে।

 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খ ম জুলফিকার তারেক বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানির উচ্চতা বাড়ছে। আগের বাঁধের ডিজাইনে বাঁধে ব্লকের ঘনত্ব ছিল ৪-৮ কাম। এখন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে তা ১৮ কাম পর্যন্ত রাখা হয়েছে। বাঁধের উচ্চতাও প্রায় ৪ ফুট বাড়ানো ধরা হয়েছে।’

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট