চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

ভূগর্ভের পানিনির্ভর ৪ শতাধিক কারখানা

মোহাম্মদ আলী 

৩ এপ্রিল, ২০২৩ | ১:১৩ অপরাহ্ণ

তীব্র পানি সংকটের মধ্যে আছে সীতাকুণ্ড ও মিরসরাইয়ের শিল্পকারখানাগুলো। চাহিদা অনুযায়ী পানি না পাওয়ায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। পানির অভাবে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদনও।

 

মূলত চট্টগ্রাম শহরের সন্নিকটে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় সীতাকুণ্ড ও মিরসরাইয়ে একের পর এক গড়ে ওঠে শিল্পকারখানা। এরমধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে মিরসরাই বঙ্গবন্ধু ইকোনমিক জোন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত এসব এলাকায় পানি সরবরাহে সরকারিভাবে কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি। সীতাকুণ্ড ও মিরসরাইয়ের পাহাড়ি এলাকা থেকে অসংখ্য ছোট-বড় ছড়া সৃষ্ট হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পতিত হয়েছে। বৃষ্টি প্রবণ এ অঞ্চলে বর্ষা মওসুমে পানি প্রাপ্যতা বেশ ভাল হলেও শুষ্ক মওসুমে পানি সংকট চরম আকার ধারণ করে। পানির এই সংকটের মধ্যে সেখানে দ্রুত শিল্পায়ন হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় যোগান কম থাকায় সেখানে পানির তীব্রতা দিনে দিনে বাড়ছে। শিল্প মালিকরা ছোট ছোট পাহাড়ি ছড়াসমূহে মাটির বাঁধ দিয়ে পানির চাহিদা পূরণের চেষ্টা করছে।

স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে সীতাকুণ্ডে শিল্পায়নের বিপ্লব ঘটে। ওইসময় সীতাকুণ্ডে ২ থেকে ৩টি শিল্প কারখানা ছিল। এরপর পাকিস্তান আমলে শিল্পকারখানার সংখ্যা আরো বাড়ে। ওইসময় শিল্পকারখানা তৈরি হয় আরো ৮ থেকে ১০টি। স্বাধীনতা পরবর্তী এটির আরো ব্যাপকভাবে প্রসার ঘটে। ৮০ এর দশকে এটি ১০০ পেরিয়ে যায়। ২০০০ সালের পর তার আরো বিস্তৃতি ঘটে। সীতাকুণ্ডে বর্তমানে প্রায় চারশ’ শিল্পকারখানা রয়েছে। কিন্তু এসব শিল্পকারখানায় সরকারিভাবে পানি সরবরাহ করা হয় না। শিল্প মালিকরা সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে এ পানির যোগান দিয়ে থাকে। মালিকরা গভীর নলকূপ, পাহাড়ি ছড়া ও লেক, খালসহ বিভিন্ন উৎস থেকে পানির চাহিদা মেটান। একই অবস্থা মিরসরাই উপজেলার শিল্প কারখানাগুলোরও। এ উপজেলায় ১২টি শিল্প-কারখানা রয়েছে। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু ইকোনমিক জোনে ইতোমধ্যে চালু হয়েছে।

 

৪টি। চালুর অপেক্ষায় রয়েছে আরো ৯টি। মূলত পাহাড়ি ছড়া ও লেক থেকে বর্ষা মওসুমে পানি পাওয়া গেলেও শুকনো মওসুমে সেভাবে পানি পাওয়া যায় না। ওইসময়ে গভীর নলকূপের পানির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হয়। শিল্পে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর আশঙ্কাজনকহারে নিচে নেমে যায়। তাতে স্থানীয় লোকজনের গভীর নলকূপে পানি পাওয়া যায় না। বছরের পর বছর ধরে পানি সংকটের এ অবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে স্থানীয় লোকজন। এ নিয়ে শিল্প মালিক ও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে একটা ‘অস্বস্তিকর’ পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে আছে।

 

পানি সংকট নিয়ে জানতে চাইলে কনফিডেন্স সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন আহমেদ দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘১৯৯৪ সালে সীতাকুণ্ডে মাদামবিবির হাট এলাকায় কনফিডেন্স সিমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের কারখানায় দৈনিক ১৫ হাজার লিটার পানির চাহিদা রয়েছে। কারখানার নিজস্ব শোধনাগারের মাধ্যমে এ পানির চাহিদা পূরণ করা হয়। কিন্তু শুকনো মওসুমে কারখানায় পানি সংকট থাকে। কারখানাসমূহে পানির চাহিদা সমাধানের জন্য পানি শোধনাগার দরকার। কিন্তু জলাধার থাকলে পানির চাহিদা সমাধান সহজ হতো। এখানকার পানি সমস্যা সমাধানে সরকার প্রকল্প গ্রহণ করলে একদিকে কারখানার পানির চাহিদা সমাধান হবে এবং অন্যদিকে ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর চাম কমবে।’

 

পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমির হোসেন সোহেল দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘২০০৩ সালে পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের যাত্রা শুরু। এরপর সবমিলে ধীরে ধীরে সীতাকুণ্ডের পিএইচপি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে ১০টি কারখানা স্থাপন হয়। আমাদের দৈনিক পানির চাহিদা ৬০০ থেকে ৮০০ টন। আমাদের কারখানার পিছনে বেশ কয়েকটি পাহাড় রয়েছে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে কিছু পানির সোর্স রয়েছে। এগুলো আগে থেকে প্রাকৃতিকভাবে ছিল। ওখান থেকে পানি নিয়ে কারখানার চাহিদা পূরণ করি। তাছাড়া বৃষ্টির পানি ধরে রাখি। কারখানা পরিচালনায় বিগত ২০ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে চাই, ভবিষ্যতে পানি সংকট একটা বিরাট ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে। আমরা যেমন গ্যাস ও বিদ্যুৎ নিয়ে সমস্যায় আছি, তেমনি পানি নিয়েও সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। যদি না আমরা এখন থেকেই সচেতন ও সজাগ না হই। বর্ষাকালে আমরা প্রাকৃতিকভাবে যে পানিটা পাই এটাকে আরো কিভাবে সংরক্ষণ করতে পারি এবং এই পানি ব্যবহারে আমাদের দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সাথে এখনই কাজ শুরু করতে হবে। অন্যথা এক সময় দেখা যাবে আমাদের কারখানাগুলোতে গ্যাস ও বিদ্যুৎ আছে, কিন্তু পানি নেই। ভবিষ্যতে এ সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। তাই গুরুত্ব সহকারে আন্ডারগ্রাউন্ড পানির নির্ভরতা কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ পানির উপর গুরুত্ব দিতে হবে। বর্ষাকালে পানি ধরে রাখার জন্য বাস্তবমুখী প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।’

 

জিপিএইচ ইস্পাতের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমাস শিমুল বলেন, ‘গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা চাহিদা অনুযায়ী না পাওয়ায় সীতাকু- এলাকার শিল্পকারখানাগুলো নানা সমস্যায় রয়েছে। এমন কি এসব সমস্যার কারণে কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তাতে আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হন শিল্প মালিকরা। সীতাকু-ে শিল্প-কারখানার পানি সমস্যা সমাধানে সরকারিভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।’

 

আলমাস শিমুল বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, রেললাইনসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার জন্য শিল্পায়নের ভাল স্থান হচ্ছে সীতাকুণ্ড। কিন্তু পানির সংকটের কারণে নতুন করে সেভাবে শিল্পায়ন হচ্ছে না। এখানে সরকারের বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ভাল সাপোর্ট রয়েছে। শুধুমাত্র পানি সংকটের কারণে শিল্পকারখানাগুলো সময়োপযোগী আধুনিকায়ন করা যাচ্ছে না। অনেকে পানির অভাবে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কারখানা নিয়ে যাচ্ছে।’

 

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘সীতাকুণ্ড এলাকার শিল্পকারখানার পানির চাহিদা পূরণে ওয়াসার কোন প্রকল্প নেই। তবে মিরসরাই বঙ্গবন্ধু ইকোনমিক জোনে পানি সরবরাহ দিতে ওয়াসা কাজ করছে। ইকোনমিক জোন থেকে ১৩২ কিলিমিটার দূরে মেঘনার পানি এনে সেখানে সরবরাহ দেওয়া হবে। এ শিল্প জোনে দৈনিক পানির চাহিদা ১০০ কোটি লিটার। এটিকে মাথায় রেখে প্রথম পর্যায়ে ২০২৮ সালের দিকে দৈনিক ৫০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ দেওয়া হবে। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে দেওয়া হবে আরো ৫০ কোটি লিটার।’

 

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট