চট্টগ্রাম রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

দুই কাউন্সিলরের ‘অপকর্মে’ বিব্রত ও শঙ্কিত অন্যরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৩ মে, ২০২২ | ১:১৫ অপরাহ্ণ

মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, দখল-বেদখল, ট্যাক্সি-টেম্পো থেকে টোকেন বাণিজ্য ও চাঁদাবাজি নিয়ে আলোচিত-সমালোচিত ও বিতর্কিত হয়ে পড়েন বোয়ালখালী পৌরসভার দুই কাউন্সিলর। সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে নেতাদের মদদে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তারা। তাদের নানা ঘটনায় এখন শঙ্কায় আছেন পৌরবাসী। বোয়ালখালী পৌরসভা নির্বাচনের পর এক কাউন্সিলর সিএনজিচালিত ট্যাক্সি থেকে টোকেন বাণিজ্য ও চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়ে পড়েন। বোয়ালখালী থেকে কাপ্তাই রাস্তার মাথা রুটে চলাচল করা ট্যাক্সি (গ্রামে চলাচল ট্যাক্সি) থেকে গণহারে চাঁদাবাজি শুরু হয়। কালুরঘাট সেতুর পূর্বপাড়ে (বোয়ালখালী) রীতিমতো চেকপোস্ট বসিয়ে টোকেন চেক করা হয়। টোকেন ছাড়া কোন ট্যাক্সি কালুরঘাট সেতু পারাপারের সুযোগ নেই। কোনো চালক টোকেন ছাড়া সেতু পার হতে চাইলে মারধর ও হেনস্তা করা হয়। টোকেনবাজির চাপ পড়েছে যাত্রীদের ওপর। লোকাল যাত্রীদের ওপর ১০ টাকা হারে বাড়তি ভাড়া নেন চালকেরা। আর রিজার্ভ ভাড়া ৫০ টাকা বাড়তি নেওয়া হয়। গত বুধবার বিকেলে ঈদের ছুটি শেষ করে শহরে ফিরছিলেন মো. হাসান নামে এক চাকরিজীবী। তিনি জানালেন, পরিবার নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় কালুরঘাট সেতুর পূর্বপাড়ে সিএনজি ট্যাক্সি আটকিয়ে টোকেনের জন্য জোর জবরদস্তি শুরু কওে ৩-৪ জন যুবক। চালকের টোকেন না থাকায় ওপারে (কাপ্তাই রাস্তার মাথা) যেতে দিলো না। বউ-বাচ্চাসহ ট্যাক্সি থেকে নামিয়ে দিয়েছে। বাড়তি ভাড়ায় আরেকটি ট্যাক্সি করে রাস্তার মাথায় পৌঁছতে হয়েছে। রাউজান থেকে বাবার বাড়ি বেড়াতে আসা গৃহবধূ রিতু জানান, দুইটি সিএনজি করে স্বামী, সন্তান, শাশুড়ি ও আত্মীয়দের নিয়ে বাবার বাড়ি বোয়ালখালী আসার প্রাক্কালে কালুরঘাট ব্রিজ পার হওয়ার পরপরই কিছু লোক সিএনজি থামিয়ে গাড়ির টোকেন আছে কিনা জানতে চান। তারা রাউজান থেকে আসছেন শুনে কিছুক্ষণ গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে পরে ছেড়ে দেন। ট্যাক্সি চালকদের অভিযোগ, এ বিষয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ করেও প্রতিকার মিলছে না। প্রতিনিয়ত হয়রানি ও মারধরের শিকার হচ্ছেন চালকেরা। সরকার দলীয় এক কাউন্সিলরের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন ট্যাক্সিচালকেরা।
এ বিষয়ে গতকাল কথা হয় বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল করিমের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘ওপারে (মেট্রোপলিটন অংশ) যাওয়ার জন্য টোকেন নেয়। এ বিষয়ে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি ট্যাক্সিকে মাসে ৫শ’ টাকা হারে টোকেন নিতে হয়। এ রুটে প্রতিদিন অন্তত ৭শ’ ট্যাক্সি চলাচল করে। সেই হিসাবে প্রতিমাসে তিন লাখ ৫০ হাজার টাকার টোকেন বাণিজ্য করা হয়। এছাড়াও দিনে প্রতি ট্যাক্সি থেকে কাপ্তাই রাস্তার মাথায় ২০ টাকা হারে ১৪ হাজার টাকার চাঁদা তোলা হয়। মাসে দাঁড়ায় ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। মাসিক টোকেন ও দৈনিক চাঁদা মিলে মাসে ৭ লাখ ৭০ হাজার টাকার চাঁদাবাজি করা হয়।
শুধু ট্যাক্সি নয়, বোয়ালখালী থেকে কাপ্তাই রাস্তার মাথা পর্যন্ত এলাকায় ২৫০টি টেম্পো চলাচল করে। রুট পারমিটধারী ২০-৩০টি টেম্পো থেকে মাসিক চাঁদা নেয়া হয় ৬শ টাকা করে। মাসে হয় ১৮ হাজার টাকা। আর পারমিটবিহীন ২২০টি থেকে মাসে তোলা হয় ১৪শ টাকা হারে। মাসে প্রায় তিন লাখ টাকা। ২৫০টি টেম্পো থেকে মাসে তোলা হয় ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। আর রাস্তার মাথায় প্রতিদিন দু’ধাপে ২০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। মাসে দাঁড়ায় তিন লাখ টাকা। মাসিক ও দৈনিক হারে টেম্পো থেকে মাসে চাঁদাবাজি হয় প্রায় ৬ লাখ ২০ হাজার টাকা। দেখা যায়, সিএনজি ট্যাক্সি ও টেম্পো থেকে মাসিক-দৈনিক ভিত্তিতে চাঁদাবাজির পরিমাণ দাঁড়ায় মাসে প্রায় ১৪ লাখ টাকা।
অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ ও সরকার দলীয় শীর্ষ নেতাদের প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেছেন কাউন্সিলরের নেতৃত্বাধীন কথিত শ্রমিক নেতারা।
বোয়ালখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আমিন চৌধুরী পূর্বকোণকে বলেন, ‘টোকেনবাজির সঙ্গে জড়িত ওই কাউন্সিলরকে কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করেছেন এমপি সাহেব। কারণ দু-একজনের অপকর্মে এমপি সাহেব ও সরকারি দলের বদনাম হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা সভায় উত্থাপন করেছি। ছোট ছোট অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করা না হলে একসময় তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।’
চাঁদা উত্তোলন করে এ ধরনের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। তারা বললেন, ট্যাক্সি ও টেম্পো থেকে তোলা সব টাকার হিসাব কাউন্সিলরকে দিতে হয়। টাকাগুলোও তাকে দিতে হয়। টাকাগুলো কাকে কাকে ভাগ দেন তিনিই জানেন। এছাড়াও আরেক কাউন্সিলরের দখল-বেদখল ও চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন এলাকাবাসী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। কয়েকদিন ধরে পক্ষে-বিপক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও কথিত অনলাইন গণমাধ্যমে তুমুল বিতর্ক চলছে।
একাধিক কাউন্সিলর নাম প্রকাশ না করার শর্তে পূর্বকোণকে বলেন, দুই কাউন্সিলরের বেপরোয়া টোকেন বাণিজ্য, চাঁদাবাজি ও দখল-বেদখলের কারণে অন্য কাউন্সিলরা বিব্রত। জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমরা লজ্জিত। তাদের অপকর্মের কারণে জনগণ আমাদের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন।

পূর্বকোণ/এস 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট