চট্টগ্রাম শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪

‘আমি সবচেয়ে জ্ঞানী’ মুসা (আ.)’র কথায় অসন্তুষ্ট হলেন আল্লাহ

খিজির (আ.) জ্ঞানার্জনের চিরাচরিত আদব শেখান মুসা (আ.) কে

নাসির উদ্দিন

৮ মার্চ, ২০২৪ | ১২:২৪ অপরাহ্ণ

জ্ঞানের উৎস একমাত্র আল্লাহ। নবী-রাসূল, ফেরেশতা, মানুষসহ সকলের জ্ঞানদাতা একমাত্র তিনি। তিনি কাউকে পরিমিত আবার কাউকে অপিরিমিত জ্ঞান দেন। আল্লাহর দেওয়া ও শেখানো কিছু বিশেষ জ্ঞান থাকে নবী-রাসূলদের। আবার আল্লাহর জ্ঞানের কাছে নবী-রাসূলদের জ্ঞান সমুদ্রের এক ফোটা পানির সমান। অর্থাৎ আল্লাহর জ্ঞানের সাথে নবী-রাসূলদের জ্ঞানের তুলনা করার কোন সুযোগ নেই। ঠিক একইভাবে নবী-রাসূলদের জ্ঞানের সাথে মানুষের জ্ঞানের তুলনা হয় না।
তাই জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে নবী-রাসূলসহ সবাইকে আল্লাহর নাম নিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ইসলামের রেওয়াজ। তাই সব সময় সাহাবীরা কোন কিছু জানলেও তা না বলে বলতেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। এর ব্যত্যয় হলে সমস্যা। যেই সমস্যায় পড়েছিলেন মুসা (আ.)। অথচ তাঁর উপর আল্লাহ আসমানী কিতাব “তওরাত” নাজিল করেছেন। আল্লাহপাক তাঁকে কলিমুল্লাহ বা মহাজ্ঞানের অধিকারী বলেছিলেন। কিন্তু “আমি সবচেয়ে জ্ঞানী” মুসা’ (আ.)র এ কথায়, আল্লাহ তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হলেন।
একবার বনি ইসরাইলের সমাবেশে ভাষণ দিতে দাঁড়িয়েছেন মুসা (আ.) । তখন তাঁকে সবচেয়ে জ্ঞানী কে, এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন,আমিই সবচেয়ে জ্ঞানী। এই উত্তরে আল্লাহ তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হলেন। মহান আল্লাহ তাঁকে সাবধান করে দেন। কেননা তিনি জ্ঞানের উৎস হিসেবে আল্লাহ্‌র কথা বলেননি। অবশ্যই তারা জ্ঞানী ছিলেন,যখন যা জানার দরকার ছিল তখন তারা ওহীর মাধ্যমে আল্লাহর কাছ থেকে জেনে সবাইকে জানাতেন।
তারপর আল্লাহ তাঁর কাছে ওহী পাঠালেন। আল্লাহ্ মুসা (আ.)–কে বললেন, দুই নদীর সংযোগস্থলে আমার এক বান্দা আছে। সে তোমার চেয়ে বেশি জ্ঞানী। মুসা (আ.) আরজ করলেন,হে আমার রব! তাঁর কাছে পৌঁছাতে কে আমাকে সাহায্য করবে?
আল্লাহ্ বললেন, তুমি যাওয়ার সময় একটি মাছ নিয়ে যাবে। সফরে যখন দরকার হবে সেখান থেকে খেয়ে নেবে। একটি মাছ ভাজা করে নিলেন মুসা (আ:)। যেখানে গিয়ে তুমি মাছটা হারিয়ে ফেলবে, সেখানেই তিনি আছেন। এর পর তিনি ও তাঁর সঙ্গি ইউশা ইবনে নুন যেতে যেতে একটি পাথরের কাছে পৌঁছে সেখানে মাথা রেখে বিশ্রাম বসলেন। মুসা (আ.) ঘুমিয়ে পড়লেন। মাছটি নড়াচড়া করতে করতে থলি হতে বেরিয়ে নদীতে নেমে গেল। আল্লাহ্ মাছটির চলার পথে পানির গতি স্তব্ধ করে দিলেন। মাছটির চলার পথ সুড়ঙ্গের মতো হয়ে গেল।
এরমধ্যে তারা উভয়ে একদিন একরাত পথ পেরিয়ে গেলেন। এর পর মুসা (আ.) ইউশা ইবনে নুনকে বললেন,আমার সকালের নাশতা নিয়ে এসো। সফরের কারণে আমি খুব ক্লান্ত। আসলে মুসা (আ.) আল্লাহর নির্দেশিত স্থানটি অতিক্রম না করা পর্যন্ত সফরে কোনো ক্লান্তি অনুভব করেননি। সঙ্গীটি বললেন,আপনি কি লক্ষ করেছেন,আমরা যখন সেই পাথরের কাছে বিশ্রাম নিয়েছিলাম, মাছটি চলে যাওয়ার কথা বলতে আমি একেবারেই ভুলে গেছি। আসলে আপনার কাছে সেটা বলতে শয়তানই আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছে। মাছটি নদীতে আশ্চর্যভাবে নিজের পথ করে নিয়েছে। পথটি মাছের জন্য ছিল সুড়ঙ্গের মতো, আর তাঁদের জন্য সেটা ছিল অবাক ঘটনা। মুসা (আ.) বললেন,এই সেই জায়গা,যা আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি। এরপর দুজনই নিজ নিজ পদচিহ্ন ধরে পেছনের দিকে ফিরে চললেন, যে পর্যন্ত না তাঁরা সেই পাথরের কাছে এসে পৌঁছালেন। তাঁরা দেখলেন, সেখানে একজন লোক বসে আছেন।
মুসা (আ.) তাঁকে সালাম করলেন। সালামের জবাব দিয়ে তিনি বললেন, এখানে সালাম এল কী করে? তিনি বললেন,আমি মুসা। লোকটি জিজ্ঞেস করলেন,আপনি কি বনি ইসরাইলের মুসা? তিনি বললেন,হ্যাঁ,আপনাকে শেখানো সহজ ও সঠিক জ্ঞানের কথা শেখার জন্য আমি আপনার কাছে এসেছি। তিনি বললেন,হে মুসা,আল্লাহর দেওয়া ও শেখানো কিছু জ্ঞান আমার আছে,আপনি তা জানেন। আল্লাহর দেওয়া ও শেখানো কিছু জ্ঞান আপনারও আছে,আমি তা জানি না।
মুসা (আ.) বললেন,আমি কি আপনার সঙ্গী হতে পারি? খিজির (আ.) বললেন, আমার সঙ্গে থাকলে আপনি ধৈর্য রাখতে পারবেন না। তাছাড়া যার রহস্য আপনার জানা নেই, সেসব ব্যাপারে আপনি ধৈর্য রাখবেন কী করে? মুসা (আ.) বললেন, ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল হিসেবে দেখতে পাবেন। আমি আপনার কোনো আদেশই অমান্য করব না।
এরপর তাঁরা দুজনে রওনা হয়ে নদীতীর দিয়ে এগিয়ে চললেন। এমন সময় একটি নৌকা তাঁদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তাঁরা তাঁদেরও নৌকায় উঠিয়ে নিতে অনুরোধ করলেন। ওঁরা খিজির (আ.)-কে চিনে ফেললেন, সঙ্গীসহ তাঁকে পারিশ্রমিক ছাড়াই নৌকায় তুলে নিলেন। তাঁরা নৌকায় ওঠার পর একটি চড়ুই পাখি এসে নৌকার একটি পাশে বসল। পাখিটি দুয়েকবার পানিতে ঠোঁট ডোবাল। খিজির (আ.) বললেন,হে মুসা,এই পাখিটি তার ঠোঁট দিয়ে নদীর পানি যতটুকু কমিয়েছে, আমার আর তোমার জ্ঞান আল্লাহর জ্ঞান থেকে ততটুকুও কমেনি।
এ সময় খিজির (আ.) হঠাৎ একটি কুঠার নিয়ে এসে নৌকার একটি তক্তা উপড়ে ফেললেন। মুসা (আ.) হঠাৎ দেখতে পেলেন তিনি কুঠার দিয়ে একটি তক্তা উপড়ে ফেলেছেন। তিনি তাঁকে বললেন, আপনি এ কী করলেন? লোকেরা আমাদের মজুরি ছাড়াই নৌকায় তুলে নিল, আর আপনি ওদের নৌকার যাত্রীদের ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য নৌকাটি ফুটো করে দিলেন? এ তো আপনি একো গুরুতর কাজ করলেন। খিজির (আ.) বললেন,আমি কি বলিনি,আপনি আমার সঙ্গে ধৈর্য রাখতে পারবেন না?
মুসা (আ.) বললেন, আমি বিষয়টি ভুলে গিয়েছিলাম। এ জন্য আমাকে দোষ দেবেন না। আমার প্রতি কঠোরও হবেন না। মূসা (আ.)-এর পক্ষ থেকে প্রথম এই কথাটি ছিল ভুলক্রমে। এর পর যখন তাঁরা দুজন নদী পার হয়ে এলেন। তাঁরা অন্য বালকদের সঙ্গে ক্রীড়ারত একটি বালকের পাশ দিয়ে গেলেন। খিজির (আ.) তার মাথাটি ধরে নিজ হাতে তার ঘাড় থেকে আলাদা করে ফেললেন। মুসা (আ.) তাঁকে বললেন, আপনি একটি নিষ্পাপ বালককে বিনা অপরাধে হত্যা করলেন? নিশ্চয়ই আপনি একটা অন্যায় করলেন।
খিজির (আ.) বললেন,আমি কি আপনাকে বলিনি,আপনি আমার সঙ্গে ধৈর্য ধরে রাখতে পারবেন না? মুসা (আ.) বললেন, এরপর যদি আমি আপনাকে আর কোনো বিষয়ে জিজ্ঞেস করি,আপনি আমাকে আর আপনার সঙ্গে রাখবেন না। কারণ আপনার ওজর–আপত্তি চূড়ান্ত হয়েছে।
আবার তাঁরা চলতে লাগলেন। অবশেষে তাঁরা একটি জনপদে এসে পৌঁছালেন। গ্রামবাসীর কাছে তাঁরা খাবার চাইলেন। কিন্তু তারা তাঁদের খাবার দিতে অস্বীকৃতি করল। সেখানে তাঁরা একদিকে ঝুঁকে পড়া একটা দেয়াল দেখতে পেলেন। সেটি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। খিজির (আ.) সেটি নিজের হাতে সোজা করে দিলেন। মুসা (আ.) বললেন, মানুষগুলো এমন যে আমরা এলাম,অথচ তারা আমাদের না দিল খাবার,না দিল আতিথ্য। অথচ আপনি ওদের দেয়াল সারিয়ে দিলেন। আপনি ইচ্ছা করলে এর বদলে মজুরি নিতে পারতেন।
খিজির (আ.) বললেন, এখানেই আপনার আর আমার মধ্যে বিচ্ছেদ হলো। তবে যে ঘটনাগুলোতে আপনি নিজের ধৈর্য ধরে রাখতে পারেননি, সেসবের রহস্য আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি। নৌকাটির ব্যপার-তা ছিল কতিপয় দরিদ্র লোকের। তারা সাগরে জীবিকা অন্বেষণ করত। আমি নৌকাটি খুঁত করতে ইচ্ছা করলাম, কেননা তাদের সামনে ছিল এক বাদশাহ । সে প্রতিটি নিখুঁত নৌকা জোর করে ছিনিয়ে নিত। আর সেই ছেলেটি ছিল কাফের। তার তার মা–বাবা ছিলেন মুমিন। আমি আশন্কা করলাম যে, পাছে সে অবাধ্যতা ও কুফুরীর দরুণ তাদেরকে বিব্রত করে। । অতএব, আমি চাইলাম যে, তাদের রব যেন তাদেরকে এমন এক সন্তান দান করেন, যে তার চাইতে পবিত্রতায় মহত্তর ও ভালবাসায় ঘনিষ্ঠতর হবে। আর প্রাচীরের ব্যাপার- প্রাচীরের তলায় ছিল নাবালক এতিমের সম্পদ। এটি ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে তা বেহাত হওয়ার আশন্কা ছিল।
আল্লাহপাক আল কোরআনের সুরা কাহ্ফ-এ এসব ঘটনা বর্ণনা করেছেন। এখান থেকে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এবং জ্ঞানার্জনের চিরাচরিত আদব শিক্ষা পাওয়া যায়। ছাত্র নিজগুণে শিক্ষক অপেক্ষা অনেক বড় হলেও শিক্ষকের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ রাখতে হবে এবং তার অনুসরণ করতে হবে। এটা ওয়াজিব। শিক্ষকের কাছ থেকে ছাত্রকে সত্যিকার অর্থে জ্ঞান অর্জন করতে হলে অবশ্যই ছাত্রকে শিক্ষকের নিকট নত স্বীকার করতে হবে।

লেখক: ব্যুরোচিফ, বাংলাভিশন, চট্টগ্রাম

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট