চট্টগ্রাম বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫

সর্বশেষ:

স্মৃতিতে হিরোশিমা শহর

কাজী আবুল মনসুর

১১ আগস্ট, ২০২৪ | ১২:১৭ অপরাহ্ণ

পৃথিবীতে মানুষ যেমন অনেক ভালো কাজ করেছে, তেমনি অসংখ্য হত্যা, নৃশংসতার নজিরও রেখেছে। একদিকে যেমন সৃষ্টি করেছে অসাধারণ সব বিষয়, আবিস্কার করেছে মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য অব্যর্থ সব ওষুধ, রচনা করেছে অনন্য সব শিল্প-সংগীত-চলচ্চিত্র। উন্নততর বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মানুষের উপকারে আসে এমন সব মহান বিষয়, তেমনি মানুষকে হত্যার জন্য ভয়াবহ সব অস্ত্রও বানিয়েছে এই মানুষই। এই পৃথিবীতে যা কিছু মানবকল্যাণের পক্ষে তাই কিন্তু টিকে থাকে, প্রশংসিত হয়। এই পৃথিবীতে মানুষ যুগ যুগ ধরেই মানবজাতির প্রতি ভালোবাসাকেই একমাত্র মৌলিক বিষয় বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। আর যারা পৃথিবীর জন্য ডেকে এনেছে ধ্বংস, ইতিহাস কিন্তু তাদেরকে ক্ষমা করে নি।

 

১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট আমাদের পৃথিবীর জন্য এক শোকাবহ কালো দিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ১৯৪৫ সালের এই দিনটিতেই মানব ইতিহাসের এক ভয়াবহ নৃশংসতম ঘটনা ঘটেছিলো জাপানের হিরোশিমা শহরে। এক ভয়ংকর পারমাণবিক বোমার সর্বগ্রাসী তেজস্ক্রীয় আগুনে এই শহরের অধিকাংশই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিলো চোখের নিমেষে। হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত সেই পারমাণবিক বোমাটির নাম ছিলো ‘লিটল বয়’। হিরোশিমায় গিয়ে এই ‘লিটল বয়’ শব্দটির সাথে আমার পরিচয়। কত ভয়ংকর ছিল এ লিটল বয়, তা বলাবাহুল্য। অনেক বছর আগে হিরোশিমা গিয়েছিলাম। হিরোশিমা যে কত সুন্দর শহর তা না দেখে বুঝার উপায় নেই। তবে হিরোশিমা ঢুকার পর ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্টের পারমিক বোমা ‘লিটল বয়’ এর ধংসের দেয়াল চিত্র যখন সবার নজরে পড়ে তখন কেউ আর অশ্রু সংবরণ করতে পারেন না। ভাবা যায়! এই লিটল বয়’ বোমাটির ভয়াবহ তেজস্ক্রীয়তায় শুধুমাত্র হিরোশিমাতেই ১৯৪৫ সালের শেষের দিক পর্যন্ত এক হিসেবে নিহত হয়েছিলো মোট ১ লক্ষ ৮০ হাজার মানুষ! এখানেই এই নৃশংসতা থেমে থাকে নি। এর তিন দিন পরেই আবার ৯ আগস্টে জাপানের নাগাসাকি শহরেও ফেলা হয়েছিলো আরেকটি পারমাণবিক বোমা। যার নাম ছিলো ‘দ্য ফ্যাট ম্যান’, এই পারমাণবিক বোমাটির তেজস্ক্রীয়তায় ৪৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সে শহরের মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিলো ৮০ হাজার!

 

হিরোশিমা শহরটি কিন্তু একদিনে গড়ে ওঠেনি। অথচ এক মুহূর্ত্যেই এ শহরটি একটিমাত্র বোমার আঘাতে গুঁড়িয়ে গিয়েছিলো। ১৫ শতকের দিকে হিরোশিমা ছিলো একটি জরাজীর্ণ গ্রাম। ১৬ শতকে মরিক্লান হিরোশিমায় একটি মন্দির নির্মাণ করেন। তখন থেকেই হিরোশিমা শহরটি হয়ে উঠেছিলো জাপানের চুগকু-শিককু জেলার সবচেয়ে বড় মন্দিরের শহর। অথচ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের ভালোবাসায় তিলে তিলে গড়ে তোলা সমৃদ্ধ এই হিরোশিমা মাত্র একটি পারমাণবিক বোমার আঘাতেই মানুষহীন, প্রাণহীন এক ভয়াবহ ধ্বংসস্তুপ, এক বেদনার্ত বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছিলো। মানুষের নির্মমতার সাক্ষী এক ধ্বংসস্তুপ হিসেবেই সেদিন থেকে হিরোশিমা পরিচিতি লাভ করে পৃথিবীর সর্বত্র। মানব-ইতিহাসে পারমাণবিক বোমার প্রথম শিকার হিরোশিমা আর এই শহরের নিরপরাধ অসহায় সব মানুষজন! এদের মধ্যে ছিলো অসংখ্য নারী, শিশু, বৃদ্ধ থেকে সব বয়সী মানুষজন, ছিলো হিরোশিমা শহরের গাছপালা, পশু-পাখি আর বেঁচে থাকা সমস্ত প্রাণীরা। এক নিমেষেই সেই প্রলয়ংকরী বোমার তেজস্ক্রীয়তায় সব পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিলো। আজ হিরোশিমা শহরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্টের সেই পারমাণবিক বোমার নৃশংস স্মৃতির স্মারক স্তম্ভ আর যাদুঘর। এই মর্মান্তিক শোকাবহ নৃশংস বেদনাদায়ক ঘটনার দিনটিকে আজও পৃথিবীর মানুষ গভীর শোকের সাথে স্মরণ করেস। আজও সেখানে গিয়ে মানুষ বেদনায় শোকে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট, হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের সেই দিনটির বিভৎস নৃশংসতার কথা ভেবে অনেকে আজো দুঃস্বপ্নের জগতে হারিয়ে যায়। সেই থেকে বিশ্বের সকল দেশে একই সাথে এই দিনটি পালিত হয়ে আসছে ‘হিরোশিমা দিবস’ হিসেবেই। জাপানের রাজধানী টোকিও’র দক্ষিণ-পশ্চিমে ৬শ’ ৮০ কিলোমিটার দূরত্বে হিরোশিমা শহর। ধ্বংসের পর সমস্ত ক্ষয়-ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে হিরোশিমার দীর্ঘদিন সময় লেগেছে। আসলে কি সব ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যায়! সেসব মানুষজন হারিয়েছে তাদের স্বজন তাদের শোক আর দুঃখ আমরা কীভাবে মোছাবো!

 

মানুষের ভালোবাসা আর বেঁচে থাকা অবশিষ্ট মানুষগুলোর জীবন জয়ী তীব্র ইচ্ছের কারণেই হিরোশিমা অবশ্য আবারো উঠে দাঁড়িয়েছে অগ্রগতির প্রতীক হয়ে। এখন সেখানে গেলে আর বোঝারই উপায় নেই যে, এই হিরোশিমা শহরেই একদিন মুখ থুবড়ে পড়েছিলো, নুয়ে পড়েছিলো বিশ্ব মানবতার সমস্ত অহংকার। সৃষ্টি হয়েছিলো বর্বর হিংস্রতার এক চ‚ড়ান্ত ইতিহাস। আজ শান্তির প্রতীকই যেন বলা যেতে পারে এই শহরটিকে, শহরটির জনসংখ্যা প্রায় ২ মিলিয়ন। আজ হিরোশিমার আকাশের নির্মল আভা, বাতাসের স্বচ্ছ আমেজ, সর্বত্র নির্ভয় সব পায়রাদের শান্তির সমাবেশ আর শিশুদের আনন্দ উলাসে তা বোঝার আর কোনো উপায়ই নেই। অটোমোবাইল ইস্পাত, প্রকৌশল, জাহাজ মেরামত, খাবার প্রক্রিয়াকরণ ও আসবাবপত্র শিল্পে শহরটি এখন বিশ্বের দরবারে সমাদৃত। বলা হয়ে থাকে, হিরোশিমা উপসাগর ঝিনুকের আধার হিসেবে বিখ্যাত আর স্নানের ক্ষেত্র হিসেবে জাপানি সংস্কৃতির ধারক। হিরোশিমা এখন শান্তির এক শহর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আজো এখানকার অনেক মানুষই এখনো নীরবে বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই ঘাতক পারমাণবিক বোমার মর্মান্তিক আঘাতের তেজস্ক্রীয় বিষ। ক্রমান্বয়ে মৃত্যুই যেনো তাদেরকে কাছে টেনে নিচ্ছে। হিরোশিমার মানুষ এখানে ধরে রেখেছেন ১৯৪৫ সালের ৬ আগষ্টের তাÐবলীলার সেই মর্মান্তিক বেদনাদায়ক স্মৃতি। এই সব স্মৃতির স্মারকগুলোর মধ্যে রয়েছে হিরোশিমার শান্তি রক্ষার প্রতীক ‘পিস মেমোরিয়াল পার্ক। সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে এই পার্কটি যেন সবাইকে শাশ্বত শান্তি রক্ষার আহŸানই জানাচ্ছে। পিস মেমোরিয়াল পার্ক আর তার চারপাশ জুড়েই আছে পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞে নিহতদের স্মরণে মিউজিয়াম বা জাদুঘর সহ অসাধারণ সব স্মৃতি স্তম্ভ। প্রতি বছর ৬ আগস্ট এখানেই পালিত হয়ে আসছে ‘হিরোশিমা দিবস’।

 

হিরোশিমার পারমাণবিক বিস্ফোরণের আরেকটি উল্লেখযোগ্য স্মৃতিচিহ্ন হচ্ছে পার্ক সংলগ্ন ‘অ্যাটমিক বোম ডোম’। ‘লিটল বয়’ নামের হিংস্র পারমাণবিক বোমাটি এখানে বিস্ফোরিত হয়েছিলো। বোমা বিস্ফোরণের সময়ে এটি ছিলো হিরোশিমা শিল্প উন্নয়ন হল। বোমা হামলায় বিধ্বস্ত হয়েছিলো ভবনের প্রায় পুরোটাই। ভবনটির কিছু অংশ এখনো দাঁড়িয়ে আছে কালের সেই নৃশংস ঘটনার বিমূর্ত স্বাক্ষী হয়েই। হলের বিধ্বস্ত কাঠামোটি টিকিয়ে রাখার জন্য ব্যয় করা হয়েছে প্রচুর অর্থ। উদ্দেশ্য একটাই পৃথিবীতে যেন কখনোই আর এমন নৃশংস ঘটনা না ঘটে! পৃথিবীর মানুষদের সামনে সেদিনের সেই নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের নৃশংসতাকে বোঝাতেই যেন সেসময়ের সেই দোমড়ানো মোচড়ানো কঙ্কালসার ভবনটিকে অবিকল তেমনই রেখে দেওয়া হয়েছে। আরেকটি স্মৃতির স্মারক হচ্ছে শান্তির শিখা। পিস মেমোরিয়াল পার্কের পেছনেই রয়েছে একটি আয়তাকার পুকুর। পুকুরটির নাম ‘শান্তি পুকুর’। এই পুকুরটির ঠিক উত্তর পাড়েই সেই শান্তির শিখা। এই শিখা বিরামহীনভাবে জ্বলছে। শান্তির এই শিখা প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে হিরোশিমা যেন পারমাণবিক অস্ত্র মুক্ত পৃথিবীর জন্য সবাইকে ডেকে ডেকে বলছে।

 

হিরোশিমা দিবস স্মরণে আরেকটি গভীর ভালোবাসা আর শান্তির জন্য প্রার্থনার একটি স্মৃতি স্মারক রয়েছে এ শহরে। এর উল্লেখযোগ্য দিকটি হচ্ছে, শিশুরাই দিনে দিনে তিলে তিলে নির্মাণ করেছে এই স্মৃতির মিনার। এর নাম ‘চিলড্রেন্স পিস মন্যুমেন্ট’। চিলড্রেন্স পিস মন্যুমেন্টকে আবার অনেকে ‘টাওয়ার অফ থাউজেন্ড ক্রেইনস’ নামেও ডাকেন। এখানকার ঘন্টাটি বাতাসে শব্দ হলেই বেজে ওঠে। চিলড্রেন্স পিস মন্যুমেন্টটি আসলে হিরোশিমার সাদাকো সাসাকি নামের ছোট্ট একটি মেয়ের স্মরণে তৈরী। বোমা বিস্ফোরণের সময়ে তার বয়স ছিলো মাত্র ২ বছর। তেজস্ক্রীয়তার কারণে সৃষ্ট রক্তের দূরারোগ্য ক্যান্সারে ১০ বছর ভূগে ভূগে প্রাণোচ্ছল সাদাকো সাসাকি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁর স্কুলের বন্ধুরা সাসাকির স্মরণে নির্মাণ করেছিলো এই মেমোরিয়ালটি। সারা পৃথিবীর শিশু থেকে সব বয়সের মানুষই এই মেমোরিয়ালে এসে ভাঁজ করা কাগজের তৈরী অসংখ্য সারস পাখি এখানে ছড়িয়ে দেয়। এর ভাস্কর্যটিও অসাধারণ। সাদাকো সাসাকির স্মরণে তার স্কুলের বন্ধুদের উদ্যোগে বানানো এই মেমোরিয়ালে সারা পৃথিবীর মানুষেরা আসেন ভালোবাসা আর শান্তির কথা বলতে।

 

পিস মেমোরিয়াল পার্কের ঠিক কেন্দ্রে আছে পার্ক মিউজিয়াম। এখানে ৪৪টি বইতে পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার রোগাক্রান্ত ১ লাখ ২৪ জনের নাম লেখা রয়েছে। ভেতরের একটি মাটির প্রকোষ্ঠে রয়েছে এক কালো পাথরের কফিন। বইগুলো সেই কফিনেই রাখা, আর কফিনের সামনের অংশে লেখা রয়েছে- “এখানের সকল আত্মাকে শান্তিতে ঘুমুতে দাও; আমরা যেন আবার এমন ক্ষতি না করি।” প্রতিটি ৬ আগস্টে ফিরে ফিরে আসে এই হিরোশিমা দিবস আর হিরোশিমার সেই নারকীয় ধ্বংসের স্মৃতিচিহ্নগুলো যেনো নিঃশব্দে আর্তি আহ্বান জানায়- বিলুপ্ত হোক যতো হত্যা, ধ্বংস আর নৃশংসতা, বিলুপ্ত হোক পৃথিবী থেকে সকল পারমাণবিক অস্ত্র, আমাদের পৃথিবী হোক শান্তি আর ভালোবাসাময়।

পূর্বকোণ/এসএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট