চট্টগ্রাম সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রাচীন এসডিও বাংলো কালের সাক্ষী

রামগড়

মো. নিজাম উদ্দিন লাভলু হ রামগড়

১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১:২৯ পূর্বাহ্ণ

এপারে সাবেক মহকুমা রামগড় আর ওপারে ভারতের ত্রিপুরার সাব্রুম মহকুমা। মাঝখানে ফেনী নদী। দু’ দেশের এ সীমানা নদীর কূল ঘেঁষে প্রকৃতির অপরূপ পরিবেশে অবস্থিত প্রাচীন দৃষ্টিনন্দন মহকুমা প্রশাসক বাংলো বা এসডিও বাংলোটি শত বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যের নির্দশন। মুক্তিযুদ্ধেরও স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনা এটি। এককথায়, এটি এখন কালের সাক্ষী। ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক প্রাচীন এ স্থাপনাটি সংরক্ষণের জোর দাবি উঠেছে। আকর্ষণীয় এ বাংলো ঘিরে একটি পর্যটন স্পট গড়ে তোলার দাবিও দীর্ঘদিনের।

১৯২০ সালে ব্রিটিশ সরকার রামগড় থানাকে তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার (জেলা সদর ছিল রাঙামাটি) দ্বিতীয় মহকুমা বা সাব-ডিভিশন হিসেবে উন্নীত করে। এর ১-২ বছর আগেই রামগড় থানা সদরে (বর্তমান উপজেলা পরিষদ সংলগ্নে) ফেনী নদীর কূল ঘেঁষে নির্মাণ করা হয় মহকুমা প্রশাসকের (এসডিও) অফিস ও বাসভবন (বাংলো)। ব্রিটিশ প্যাটার্নে বিশেষ নির্মাণ শৈলীতে বানানো হয় এসডিও সাহেবের বাংলোটি। ৩ হাজার ৪৬৫ বর্গফুটের বিশাল এ বাংলো তৈরি করা হয় মাচানঘরের আদলে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার ১০ ইঞ্চি ব্যাসের ইটের তৈরি শতাধিক পিলারের ওপর আঁড়াআঁড়িভাবে মোটা ও শক্ত কাঠের চৌকাঠ স্থাপন করা হয়। এর ওপর কাঠের চিড়াই তক্তা বিছিয়ে ফ্লোর বা মেজে বানানো হয়। ৬৩০ বর্গফুটের বারান্দাসহ এভাবে কাঠ বিছিয়ে তৈরি করা ৩ হাজার ৪৬৫ বর্গফুট ফ্লোরের ওপর শক্ত ও মোটা কাঠের খুঁটি স্থাপন করে নির্মাণ করা হয় বিশাল বাংলোটি। বাঁশের বেড়ার ওপর বালু সিমেন্টের আস্তর বা প্লাস্টার করে তৈরি করা হয় বাংলোর ভিতরের-বাহিরের সবগুলো দেয়াল। কাঠের ফ্লোর হতে এ দেয়ালের উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। বাঁশের দেয়ালের প্লাস্টারে চুনের সাদা রঙের প্রলেপ দেয়া হয়। শত বছরের এ বাঁশের দেয়াল কিংবা চিরাই কাঠের ফ্লোর বা মেজে এখনও অক্ষত। টিনের ছাউনির এ মাচান বাংলোয় উঠা-নামার জন্য সামনে একটি বড় ও প্রশস্ত আরসিসি সিঁড়ি ছাড়াও পিছনে ছোট আকারের ৪টি এবং পশ্চিম পাশে দুটি সিঁড়ি রয়েছে। বাংলোয় ৪টি বড় কামরা এবং ৮টি ছোট কামরা রয়েছে।

জানা যায়, রামগড়ের আশপাশের বিভিন্ন বনাঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয় বাংলোর নির্মাণকাজে ব্যবহৃত জারুল, গর্জন ইত্যাদি কাঠ ও বাঁশ। চাঁদপুরের হাজিগঞ্জ থেকে করাতিদের এখানে এনে কাঠ চিরাইয়ের কাজ করানো হয়। লালু প্রসাদ বাবু নামে এক ঠিকাদার বাংলোর কাজ করেন। সীতাকু- থেকে ধুমঘাট হয়ে ফেনী নদী পথে আনা হয় ইট, চুন ইত্যাদি নির্মাণসামগ্রী। নির্মাণকাজের শ্রমিকদের সর্দার ছিলেন পঞ্চ কুমার ত্রিপুরা। ব্রিটিশ সরকারের এক সিনিয়র মেম সাহেব কাজকর্ম দেখতে চট্টগ্রাম থেকে ধুমঘাট হয়ে নদীপথে রামগড়ে আসতেন মাঝেমধ্যে। স্বাধীন ত্রিপুরা রাজ্য ব্রিটিশ শাসনের আওতা বহির্ভূত ছিল তখন। জনশ্রুতি আছে, সেই কারণে ফেনী নদীর ওপারের সাব্রুম মহকুমা নজরদারির সুবিধার্থে নদীর এপারে তীরঘেঁষে তড়িঘড়ি করে রামগড় এসডিও অফিস ও বাংলো নির্মাণ করা হয়।

১৯৭০ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সরকারের এক আদেশে মহকুমা সদর রামগড় থেকে প্রায় ৪০ মাইল দূরে মহালছড়ি থানার খাগড়াছড়ি ইউনিয়নে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি হতে রামগড় এড খাগড়াছড়ি মহকুমা নামে সেখানে কার্যক্রম চালু হয়। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নির্দেশে মহকুমা সদর পুনরায় রামগড়ে স্থানান্তর করা হয়। মহকুমা সদর দপ্তর খাগড়াছড়িতে স্থানান্তর হলেও এসডিও বাংলো ব্যবহার করতেন অন্য কর্মকর্তাগণ। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন বহু স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যবাহী এই এসডিও বাংলোটি। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল পাকবাহিনী রাঙামাটি দখল করার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা সদর সেখান থেকে রামগড়ে স্থানান্তর করে নিয়ে আসা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন ডিসি এইচ.টি ইমাম (বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা) এই এসডিও বাংলোতে অবস্থান করতেন। ১৯৭১ সালের ২ মে রামগড় পতন পর্যন্ত এখান থেকে তিনি স্বাধীন বাংলা সরকারের অধীনে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রটি পাকবাহিনীর হাতে আক্রান্ত হওয়ার পর ৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে ওই বেতার কেন্দ্রের এক কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন ট্রান্সমিটারটি রামগড়ে নিয়ে আসেন ওখানকার কয়েকজন সাহসী যুবক। এসডিও বাংলোতে ট্রান্সমিটারটি বসিয়ে এখান থেকে কিছুদিন সম্প্রচার করা হয় স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান।

১৯৮৩ সালে খাগড়াছড়ি মহকুমাকে জেলায় উন্নীত এবং রামগড় মহকুমাকে উপজেলায় অবনমিত করার পর মহকুমা প্রশাসন বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ কারণে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে প্রাচীন ঐতিহ্য এসডিও অফিস এবং এসডিও বাংলোটি।
জানা যায়, আশির দশকে পুরাতন এসডিও অফিস এলাকায় তৎকালীন বিডিআর (বর্তমান বিজিবি)’র ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেই সময় এসডিও বাংলোটি ব্যবহৃত হয় বিডিআরের ব্যাটালিয়ন অধিনায়কের বাসভবন হিসেবে। আশির দশকের শেষার্ধে ব্যাটালিয়ন সদর সীমান্তঘেঁষা এসডিও অফিস এলাকা থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে তৈচালাপাড়ায় স্থানান্তরিত করা হয়। এ কারণে আবারও পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে প্রাচীন এসডিও বাংলো ও অফিস ভবন। নব্বই দশকের শেষে এসডিও অফিসটিতে বিডিআরের একটি বিশেষ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। কিন্তু পরিত্যক্ত থেকে যায় এসডিও বাংলোটি। পরিত্যক্ত থাকা অবস্থায় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলোটি। ১৯৯৬ সালে পরিত্যক্ত এসডিও বাংলোতে উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিস ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস চালু করে। অফিস দুটি চালুর পর বাংলোটি ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাংলোর পশ্চিম অংশে ইট, চুন, সুরকি দিয়ে তৈরি করা এসডিও বাংলোর কর্মচারীর ছোট ছোট ঘরগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন শুধু ওই ঘরগুলোর ধ্বংসাবশেষ সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

২০০১ সালে বিএনপি সরকারের সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অর্থায়নে রামগড় উপজেলা পরিষদ এলাকায় পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের মেগা প্রকল্পের অধীনে পুরাতন এসডিও অফিস ও বাংলো এলাকায় একটি বিশাল পিকনিক অডিটোরিয়াম ও একটি লেক তৈরি করে এর ওপর একটি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঘুরতে আসা পর্যটকরা দেখতে আসেন প্রাচীন এসডিও বাংলোটি। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত, ফেনী নদী, সারি সারি সেগুন, বেল, তাল, আম, কাঁঠাল, লিচুসহ নানান গাছপালা, দৃষ্টিনন্দন প্রাচীন এসডিও বাংলো সবকিছুই মনোমুগ্ধকর। বাংলোর সামনের ঠিক পশ্চিম অংশে রয়েছে অতি পুরাতন দুটি কাঁঠালী চাঁপা ফুল গাছ। কাঁঠালীর তীব্র সুগন্ধ পুরো এলাকা সুবাসিত করে রাখে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট