চট্টগ্রাম শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪

আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস

ডেইজী মউদুদ

২৭ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:১৭ পূর্বাহ্ণ

গত ২৫ নভেম্বর ছিল ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর দ্য এলিমিনেশন অব ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন’ বা আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। একই সাথে সেদিন থেকে শুরু হয় আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষও। আগামী ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পর্যন্ত পৃথিবীর দেশে দেশে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এ পক্ষ পালিত হবে। বাংলাদেশের নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এ উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এই দিবসের সংক্ষিপ্ত এক প্রেক্ষাপট রয়েছে। সেটি হলো ১৯৬০ সালে ল্যাটিন আমেরিকার ডমিনাল রিপাবলিকান স্বৈরসরকারের বিরুদ্ধে ন্যায় সঙ্গত বিদ্রোহ করায় প্যাট্রিয়া, ম্যারিটা তেরেসা এবং মিরানাল মিনার্ভা নামের তিনবোনকে হত্যা করা হয়েছিল ২৫ নভেম্বর। এই নির্মম ঘটনার প্রতিবাদে বিভিন্ন নারী সংগঠন প্রতিবাদের ঝড় তুলেন। মিছিলে মিটিং এ তারা প্রতিবাদ জানিয়ে এই ঘটনার বিচার দাবি করেন। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ১৯৮১ সালে লাতিন আমেরিকায় নারীদের এক সম্মেলনে ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৯৩ সালে ভিয়েতনাম বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলন দিবসটিকে স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘ দিবসটি পালনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ দিবস উদ্যাপন কমিটি ১৯৯৭ সাল থেকে এই দিবস ও পক্ষ পালন করছে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত দেশে ২৪ হাজার ৬৩১টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নির্যাতনের ঘটনা চার হাজার ১৪৬টি।

প্রতিনিয়ত বিকশিত হচ্ছে আমাদের সমাজ। কিন্তু এখনও বন্ধ হয়নি নারী নির্যাতন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সংগঠনের জরিপ ও গবেষণায় দেখা গেছে, পারিবারিক নির্যাতন বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপে দেখা যায়, ১০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশের ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বিবাহিত জীবনে কোনো না কোনো সময়ে আর্থিক, মানসিক, শারীরিক কিম্বা যৌন নির্যাতনের শিকার ৮০ দশমিক ২ ভাগ নারী। বিবাহিত জীবনে ৮৭ শতাংশ নারী জীবনে কোনো না কোনো সময়ে নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানায়, অক্টোবর মাসে পারিবারিক নির্যাতনে ২৮ জন নারীকে হত্যা করা হয়। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাসে মোট ৩০৫টি পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ২০৭ জন নারীকে স্বামী হত্যা করেছে। নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে ৩৯ জন। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির ২০১৬ ও ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৬ সালে অক্টোবর মাস পর্যন্ত নারী নির্যাতনের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৮২৫টি, যা ২০১৭ সালের একই সময়ে ৫৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ১৯৬টি। নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন নারী সংগঠন সারাদেশে বহুমূখী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কেন এধরণের নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে এবং নারী নির্যাতন নির্মূল হচ্ছে না এর কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করছে, প্রতিরোধের লক্ষ্যে কাজ করছে। নারীরা পাহাড়ের চূড়ায় উঠা থেকে শুরু বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করেছে। খেলার মাঠ থেকে শুরু করে নানা চ্যালেঞ্জিং পেশায় অংশগ্রহণ করছে। অথচ, নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার মূলে রয়েছে মনস্তত্ত্ব, পিতৃতন্ত্র ও বৈষম্যমূলক আইন। ইতিহাস, দর্শন, শিক্ষা কারিকুলাম নারীর প্রতিকূলে।

রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নও নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। রাষ্ট্র আপোষহীন এবং নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ না করলে সমাজের ভিতরের এই অবক্ষয় রুখে দাঁড়ানো যাবে না। বেসরকারি সংগঠন নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কাজ করলেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এক্ষেত্রে মাল্টিসেক্টরাল এপোচে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা জরুরি। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও নির্মূলে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি, সংসদ সদস্য ও নীতিনির্ধারকদেরও জোরালো ভূমিকা থাকা অত্যাবশ্যক। পরিবারের দায়িত্ব নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা। নাগরিক আন্দোলনকে আরো সোচ্চার হতে হবে, গণমাধ্যমকে আরো সজাগ থাকতে হবে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোর হতে হবে। সমাজকে অগ্রসর করতে হলে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন বন্ধে সবাইকে এগিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট