চট্টগ্রাম সোমবার, ১৭ জুন, ২০২৪

ঘূর্ণিঝড় এলে চট্টগ্রামে দ্বিমুখী বিপদ, জলোচ্ছ্বাস-পাহাড়ধস

মো. শাহজালাল মিশুক

২৬ মে, ২০২৪ | ৯:৫৪ অপরাহ্ণ

এপ্রিল ও মে মাসে বঙ্গোপসাগরে প্রতিবছরই সৃষ্টি হয় নিম্নচাপ যা পরে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ ধারণ করে। অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চলের পাশাপাশি বন্দরনগরী চট্টগ্রামও থাকে বিপদজনক ঝুঁকির তালিকায়। সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া গভীর নিম্নচাপটি ঘনীভূত হয়ে ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’-এ পরিণত হয়েছে। বেশ ভয়াবহ রূপ ধারণের কারণে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ইতোমধ্যেই বন্দরে ‘অ্যালার্ট-৩’ জারি করা হয়েছে। খোলা হয়েছে চারটি কন্ট্রোল রুম। জেটি ও বহির্নোঙ্গরে থাকা জাহাজের পণ্য উঠানামা বন্ধ করা হয়েছে। তবে, যেসব জাহাজে পণ্য উঠানামা অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় আছে, সেসব জাহাজে দ্রুত কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে।

 

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সন্ধ্যা থেকে বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকা ও উপকূলে মাইকিং করে মানুষকে নিরাপদে থাকার অনুরোধ জানাচ্ছে। বিশেষ করে নগরীর বায়েজিদ, বাটালিহিল, লালখান বাজার, ষোলশহরসহ বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের অবিলম্বে সরে যেতে বলা হয়েছে।

 

তবে অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের সময় জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা তীব্র অবস্থায় থাকলেও চট্টগ্রামে এর সাথে যুক্ত থাকে আরেকটি দুর্যোগ পাহাড়ধস। কারণ ঘূর্ণিঝড় যদি জোয়ারের সময় স্থলভাগের উপর দিয়ে প্রদক্ষিণ করে তাহলে জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয় এবং ক্ষয়ক্ষতি অনেক বৃদ্ধি পায়। তবে চট্টগ্রামে ঘূর্ণিঝড়ের ফলে যদি অতিবৃষ্টি হয়, তাহলে জলোচ্ছ্বাসের পাশাপাশি পাহাড়ধসের তীব্র সম্ভাবনা থাকে। তাই চট্টগ্রাম নগরীতে ঘূর্ণিঝড়ের সময় জলোচ্ছ্বাসের পাশাপাশি পাহাড়ধসের ঝুঁকি ব্যাপারটিও বেশ কঠোরভাবে নজর দিতে হয়।

 

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে বাংলাদেশ উপকূলে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল এবং ২৫৫ কি.মি. বেগে অবিরাম বাতাসের সঙ্গে ৬ কি.মি. জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলে আনুমানিক ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। তাই ঘূর্ণিঝড় রিমাল মোকাবিলায় ১৯৯১ সালের সেই ঘূর্ণিঝড় বিবেচনায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও জেলা প্রশাসনকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

 

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মাল্টি হ্যাজার্ড কনটিনজেন্সি প্ল্যানের ফিল্ড সার্ভে ও আমেরিকান জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশনে প্রকাশিত গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সমুদ্র তীরের ওয়ার্ডগুলো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সেক্ষেত্রে কাট্টলি, বাকলিয়া, হালিশহর ও পতেঙ্গা এলাকা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। অর্থাৎ ওয়ার্ড নম্বর ১০, ১১, ১৮, ১৯, ২৬, ৩৮, ৩৯ ও ৪১ হল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। পাশাপাশি পাহাড়তলী, সরাইপাড়া ও বক্সিরহাট এলাকাও। অর্থাৎ ওয়ার্ড নম্বর ৯, ১২, ৩৫, ৩৭ ও ৪০ হল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা।

 

তাই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষকে অতিদ্রুত উক্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষের জন্য বেশ কিছু জরুরি কাজ সম্পাদন করতে হবে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের অতিদ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা। পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্রে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো ও শেল্টার ম্যানেজমেন্ট অতি দ্রুত প্রয়োজন। অন্যদিকে আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষদের জন্য শুকনো খাবার ও প্রাথমিক চিকিৎসা সামগ্রী সংরক্ষণ করতে হবে। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলোতে পর্যাপ্ত স্বেচ্ছাসেবী প্রস্তুত রাখতে হবে। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবীদের প্রস্তুত রাখতে হবে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক খোলা জরুরি কন্ট্রোল রুম ২৪ ঘণ্টা কার্যকরভাবে খোলা রাখতে হবে। পাশাপাশি পাহাড়ধসের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থানরত মানুষদের অতিদ্রুত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হবে।

 

অন্যদিকে চট্টগ্রাম নগরী হলো পাহাড়ে ঘেরা এবং এই পাহাড়গুলোই নগরীর অন্যতম আকর্ষণ। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে অতিবৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে, যা নগরীর পাহাড়ধসের সম্ভাবনা অনেকাংশেই বাড়িয়ে দিচ্ছে। কারণ পূর্বেও অতিবৃষ্টির কারণে পাহাড়ধস ঘটেছিল যাতে ১৯৯৯ থেকে ২০০৭ সালে ২৭০ জনের বেশি মানুষ নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। তাই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এর জন্য করা মাল্টি হ্যাজার্ড কন্টিনজেন্সি প্লানে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলোর তথ্য প্রদান করা হয়েছে। যেখানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ১, ২, ৩, ৭, ৮, ৯, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬ ও ২২ নম্বর ওয়ার্ড অতিবৃষ্টির কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। একটু গভীর বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এই সকল ওয়ার্ডের মতিঝর্ণা, লালখান বাজার, টাঙ্কিরপাহাড়, বাটালিহিল, গোল পাহাড়, এ কে খান পাহাড়, রৌফাবাদ পাহাড়, ফিরোজশাহ, কুসুমবাগ, জালালাবাদ, মুক্তিযোদ্ধা পাহাড়, আরেফিননগরকে সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই ঘূর্ণিঝড় রিমালের ফলে অতিবৃষ্টি হলে, এই সকল ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষ পাহাড়ধস থেকে রক্ষা পেতে অতিদ্রুত সিটি কর্পোরেশন ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের সরিয়ে নেয়া উচিত।

 

পরিশেষে বলব, ইতোমধ্যে ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাত ও জানমাল রক্ষায় চট্টগ্রামের উপকূলীয় চার উপজেলাসহ জেলার ১৫ উপজেলা ও সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই রিমাল মোকাবিলায় চট্টগ্রামে প্রস্তুত এক হাজার ৯২৫টি আশ্রয়কেন্দ্র। এর মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের ৭৮৫টি আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও এক হাজার ১৪০টি বিদ্যালয় রয়েছে। এ ছাড়া নয়টি মুজিব কেল্লা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তবে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের পাশাপাশি অতিবৃষ্টির ফলে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের ঘটনাও ঘটতে পারে সেদিকে কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে। তাই ঝুঁকি মোকাবিলায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া এবং সেই সময়ে তাদের বাড়িঘরের নিরাপত্তা প্রদান করা। অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলে, জরুরি উদ্ধার কিংবা ত্রাণ-সাহায্য বিতরণ থেকে শুরু করে ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী কার্যক্রম কীভাবে পরিচালনা হবে তার সুস্পষ্ট এবং কার্যকর পরিকল্পনা অতিদ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।

 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)

 

 

পূর্বকোণ/জেইউ/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট