চট্টগ্রাম শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

‘মরহুম হতে চাই না, বিমান যাত্রীদের সেবায় বাঁচতে চাই’

১ মার্চ, ২০২২ | ৫:৩৭ অপরাহ্ণ

স্মৃতিচারণ : (১)

অনেকদিন আগের কথা, তখন দেশের অভ্যন্তরে কোনো বেসরকারি বিমান সংস্থা ছিল না। তাই একমাত্র জাতীয় পতাকাবাহী ‌‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স’র চট্টগ্রামস্থ টিকেট কাউন্টারে যাত্রীসাধারণ প্রতিদিন বিমানের সেবা গ্রহণ করতে এসে অনেক ভিড় জমাতেন। অসংখ্য যাত্রী বিমান অফিসে এসে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ জন কর্মকর্তা/কর্মচারীর সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে বিমানের সেবা গ্রহণ করতেন।

প্রসঙ্গত, তখনকার দিনে আজকালের মতো কোথাও টোকেন পদ্ধতিও চালু ছিল না। টিকেট কাউন্টারে নিয়োজিত বিমানের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজ ছিল- অতি অল্প সময়ের মধ্যে প্রত্যেকের সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের সকল রকম উন্নত সেবা দিয়ে সসম্মানে বিদায় করা। তারাও এ রুটিনওয়ার্ক আমার (অফিসার ইনচার্জ, কাউন্টার) তত্ত্বাবধানে যথাযথভাবে প্রতিদিন নিয়মিত সমাধা করতেন। তাদের কাজকর্মে যথেষ্ট গতি ও আন্তরিকতা ছিল। তথাপি বিমানের স্থানীয় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, আরও তড়িৎ ও উন্নতসেবা আগত যাত্রীদের বিমানের যে কর্মকর্তা-কর্মচারী সবচেয়ে বেশি দিতে পারবেন,  প্রতিমাসে তাদের একজন করে ‘ম্যান অফ দি মান্থ’ বা ঐ মাসের ‘মাসিক শ্রেষ্ঠ সেবক’ নির্বাচিত করা হবে এবং তার ছবি সারামাসব্যাপী একটি সুন্দর ফ্রেমে বাঁধাই করে যাতে যাত্রীসাধারণের দৃষ্টিগোচর হয় বিমান কাউন্টারের এমন স্থানে ঝুলিয়ে রাখা হবে! এর কারণ হিসেবে স্থানীয় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মনে করলেন- কাউন্টারে কর্মরত ঐ ‘মাসিক শ্রেষ্ঠ সেবক’সহ অন্য সকলে হয়তো দৈনন্দিন কাজকর্মে আরও উৎসাহবোধ করবেন এবং তাদের নিজেদের মধ্যে অঘোষিত একটি সুপ্ত প্রতিযোগিতা শুরু হবে। ফলে যথা সময়ান্তে এবং যথারীতি ‘মাসিক শ্রেষ্ঠ সেবক’ নির্বাচিত হলো। নিয়মানুযায়ী পরবর্তী মাসে ঐ সর্বজনস্বীকৃত ‘মাসিক শ্রেষ্ঠ সেবক’ এর ছবিও কাউন্টারের যথাস্থানে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। সেই ‘মাসিক শ্রেষ্ঠ সেবক’ পরবর্তী মাসগুলোতেও এ সম্মান ধরে রাখার মানসে আরও সেবার মান বাড়িয়ে দিলেন এবং তার সাথে প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিতে অন্যরাও কাজকর্মে অধিক মনোযোগী হয়ে পড়লেন। বিভ্রান্তি ঘটলো তখনি, যখন তারপরের কোনো একদিন দেখা গেলো, ঐ ছবিটার সামনে যাত্রীসাধারণের অনেক ভীড়!

উল্লেখ্য যে- ভাগ্যিস ঐদিন ছিলো ঐ তথাকথিত ‘মাসিক শ্রেষ্ঠ সেবক’ এর সাপ্তাহিক ছুটি। ছবিটার সামনে যাত্রীদের ভিড় দেখে কৌতুহলবশত আমি ওখানে গিয়ে সকলের কথাবার্তা শুনে তাজ্জব বনে গেলাম!। আমি ওখানে গিয়ে শুনলাম, যাত্রীদের কেউ কেউ বলছেন, ‘লোকটা খুবই ভালো ছিলেন, বিমানে এ রকম ভালো লোক আর হয় না! ক’দিন আগেও তো তার সেবা নিয়েছি। কিভাবে মারা গেলেন! আল্লাহ তাকে বেহেস্তে নসিব করুক। ইত্যাদি ইত্যাদি।

আরো কত কি যেন বলাবলি করছেন সবাই। আমি আর শুনতে চেষ্টা করলাম না! তবে তাদের কথাবার্তা থামাতে চেষ্টা করে আসল ব্যাপারটা তাদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু ব্যর্থ হলাম। তবে ততক্ষণে কাউন্টারের চারিদিকে হৈ চৈ শুরু হয়ে গিয়েছে। তাদের কাউকেই থামাতে না পেরে শেষে তখনকার মত ঐ স্থান ত্যাগ করা উচিৎ বলে মনে করলাম।
কিন্তু এ অনাকাঙ্ক্ষিত কথাগুলো সবার মাধ্যমে অতি দ্রুত কাউন্টারে কর্মরত সবার কানে পৌঁছে গেলো।

এবার বুঝলাম, কাউকেই বুঝি আর সামলানো যাবে না। ভাবলাম, তবে কি মৃত্যুভয়ে কাউন্টারের সকলের কাজ কর্মে ভাটা পড়ে যাবে? নাহ! এ হতে দেয়া যায় না!

তারপর আমি দ্রুত তৎকালীন জেলা ব্যবস্থাপকের রুমে গিয়ে তাকে বিষয়টি অবহিত করলাম এবং তার পরবর্তী নির্দেশের জন্যে তার দিকে হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম।

পরক্ষণেই দেখলাম, আমাদের জেলা ব্যবস্থাপক মহোদয় অট্টহাসিতে লুটিয়ে পড়লেন। তাতে আমি কিছুটা আরও বেশি বিব্রতবোধ করতে শুরু করলাম। আমার আরও চিন্তা যে এদিকে মাসের প্রায়ই শেষ। ‘মাসিক শ্রেষ্ঠ সেবক’ পুনরায় নির্বাচন আসন্ন। কি করি?

কিছুক্ষণ পরে দেখলাম, সদলবলে কাউন্টারের সকল বিব্রত কর্মকর্তা-কর্মচারী জেলা ব্যবস্থাপকের রুমে হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করলেন।

তখনও দেখতে পাচ্ছি, জেলা ব্যবস্থাপকের মুখে মুচকি হাসির রেশ লেগেই আছে। তারপর তিনি সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, বিষয়টি শুনেছি, তবে আস্তে আস্তে সবই ঠিক হয়ে যাবে। প্রয়োজনে ছবির নিচে ‘মাসিক শ্রেষ্ঠ সেবক’ লেখাটি আরও বড় করে লিখে দিতে হবে।

তারপর উপস্থিত সবাই আমাদের উদ্দেশ্যে একসাথে বললেন- স্যার, এসবের আর দরকার হবে না। আপনাদের মহতী উদ্যোগে আমরা সত্যি ভীষণ খুশি হয়েছি যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। কথা দিচ্ছি, আমরা সেবার মান আরও বৃদ্ধি করবো। তবে আমরা কেউ ‘মাসিক শ্রেষ্ঠ সেবক’ হতে চাই না স্যার, বরঞ্চ আজীবন বিমানের শ্রেষ্ঠ সেবক হয়ে বেঁচে থাকতে চাই।

পরক্ষণেই স্যারের সম্মতি পেয়ে সবাই রুম থেকে বের হতে লাগলেন। তবে শুনতে পেলাম স্যারের রুমের দরজা দিয়ে বের হবার সময় কেউ কেউ বলছেন- আমরা কেউ মরহুম হতে চাই না, বিমান যাত্রীদের সেবা করার জন্যে বেঁচে থাকতে চাই।’

তাদের কথাগুলো শুনে এবার স্যার আর আমি উভয়েই অট্টহাসিতে সামিল হলাম।
রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান সদর্পে এগিয়ে যাক, এটি সবার কাম্য। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সকল যাত্রীও সংশ্লিষ্ট সকলে সুবর্ণজয়ন্তীর ধারক ও বাহক। তাই সকলের প্রতি শুভেচ্ছা রইলো। (সংগৃহীত নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা)

লেখক: জেলা ব্যবস্থাপক (প্রাক্তন), বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম

 

পূর্বকোণ/এএইচ/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট