চট্টগ্রাম বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

হজ ওমরাহকারীর কল্যাণে হারামাইন এক্সপ্রেস

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী

২১ অক্টোবর, ২০২৪ | ১:০৯ অপরাহ্ণ

পবিত্র মক্কা থেকে পবিত্র মদিনা ৪২৫ কি.মি যা আমাদের দেশের দূরত্বে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার। সৌদি সরকার হজ্ব ওমরাহ যেয়ারতকারীগণের কল্যাণে উভয় পবিত্র নগীরতে যাতায়াত সহজতর করার জন্য বুলেট ট্রেন তথা হাই স্প্রিড ট্রেন চালু করে। ইহা পবিত্র মদিনায় রওজাপাকে যেয়ারতকারীগণের কল্যাণে সৌদির মানসিকতা পরিবর্তনের লক্ষণ। প্রায় দুই দশকের কম বেশি সময় আগে থেকে এ ট্রেন লাইন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। আমাদের দেশে যে কোন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে থেমে যাওয়া পুনঃ ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে দেয়া অনেকটা রেওয়াজে পরিণত। যে কোন প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে শেষ হয় না। সৌদিতে তার ব্যতিক্রম। যে কোন কাজ শুরু হয়ে রাত-দিন চলমান থাকে। অনেক ক্ষেত্রে সময়ের আগেই কাজ শেষ হয়ে যায়।

 

১৯৩০ এর দশকে সৌদি আরবে স্থল যোগাযোগ শুরু হয়। মরুভূমি প্রবণ অঞ্চল বালি সরিয়ে দিলে রাস্তা হয়ে যায়। ঐ সময় সরু এক লাইনে পবিত্র মক্কা-পবিত্র মদিনা-জেদ্দা সড়ক যোগাযোগ ছিল। ১৯৫০ এর দশকেও পবিত্র মক্কা থেকে সড়কপথে গাড়ি যোগে পবিত্র মদিনা যেতে ২ দিন ২ রাত সময় যেত। পরবর্তীতে যোগাযোগ আরও উন্নত হয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ের মত একই সড়কে উভয় দিকে যাতায়াত করা হত। বর্তমান পবিত্র মক্কা-পবিত্র মদিনা যাওয়া-আসা ৬ লাইন বিশিষ্ট প্রকান্ড হাইওয়েটি চালু হয় ১৯৮৪ সালে। ১৯৮০/৯০ এর দশকেও সৌদির হজ্ব ওমরাহকারীর যেয়ারত নিয়ে মন মানসিকতায় ভিন্নতর ছিল। যেহেতু আহলে হাদীস তথা সালাফীর মতাদর্শ মতে যেয়ারতের নিয়তে পবিত্র মদিনা গমন করা যাবে না। মসজিদে নববীতে নামাজের নিয়তে যেতে হবে। ২০/২৫ বছরের ব্যবধানে সৌদিদের মাঝে মন মানসিকতায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে। তারা হয়ত অনুধাবন করতে পেরেছে বিশ্বে ২ শ’ কোটি উম্মতে মুহাম্মদীর পবিত্র মদিনা গমনের একমাত্র নিয়ত আবেগপ্লুত চিত্তে রওজাপাকে সালাম পেশ করা। হয়ত সৌদি কর্তৃপক্ষ বাড়াবাড়ি থেকে সরে এসে নমনীয় হয়ে যায়। ইহা হয়ত বাদশাহ ফাহাদের মন মানসিকতার ফসলও হতে পারে।

 

১৯৮৫ সালের আগ পর্যন্ত মসজিদে নববীর নামাজীর ধারণ ক্ষমতা ছিল সর্বোচ্চ ৩০-৩৫ হাজার নর-নারীর। ঐ সময় পবিত্র মদিনা শহরে দালানের পাশাপাশি খেজুর গাছের বীম দিয়ে ৩/৪ তলা বিশিষ্ট মাটির ঘরও কম ছিল না। বাদশাহ ফাহাদ মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়ে মসজিদে নববীকে বিশালভাবে সম্প্রসারণ করে দেন। এতে সময় লাগে প্রায় ১১ বছর। মসজিদে নববীর ধারণ ক্ষমতা ৩০-৩৫ হাজারের স্থলে ৪/৫ লাখে উন্নিত হয়। সাথে সাথে যেয়ারতকারীগণের কল্যাণে পূর্বপাশে জান্নাতুল বাকী বাদ দিয়ে অপর তিন দিকে শতাধিক ১৫/২০ তলা বিশিষ্ট স্টারমানের হোটেল নির্মাণ করা হয়। পবিত্র মদিনাকে নতুনভাবে সাজিয়ে দেয়া হয়। স্বভাবতই পরবর্তীতে বাদশাহ আবদুল্লাহ এবং বর্তমান বাদশাহ সালমান বাদশাহ ফাহাদের অনুকরণে অনুসরণে এখানে আরও দুইটি জিনিস সংযোজন করেন।

 

১) ছোট কলেবরে পবিত্র মদিনা বিমান বন্দরকে জেদ্দা, রিয়াদের মত এ ক্যাটাগরীতে উন্নিত করা হয়। সাথে সাথে জেদ্দার মত হজ টার্মিনাল (যেয়ারতের টার্মিনাল) নির্মাণ করে।

২) বুলেট ট্রেন তথা হাই স্প্রিড ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়। এতে মাত্র ২ ঘন্টা ১০ মিনিটে পবিত্র মক্কা থেকে পবিত্র মদিনা পৌঁছা অথবা পবিত্র মদিনা থেকে পবিত্র মক্কা আসা যায়।

 

বিশ্ব ধারণাতীত উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। মানুষ দ্রুত যাতায়াত করতে চায়, চায় শারীরিক আরাম। আকাশপথ যে হারে উন্নতি লাভ করেছে যা ৪০/৫০ বছর আগেও চিন্তা করা যেত না। সার্বিক বিবেচনায় বর্তমানকালের প্রেক্ষাপটে দুই পবিত্র নগরীর মধ্যে অতি সহজ যাতায়াতের জন্য হারামাইন এক্সপ্রেস ট্রেন যথাযত। যেহেতু পবিত্র মক্কায় বিমান বন্দর নেই, প্রায় ১ শত কি.মি দূরত্বে জেদ্দা গিয়ে বিমানে পবিত্র মদিনা যাওয়া-আসা করতে হয়। আমারও পরপর দু’বার উক্ত হারামাইন এক্সপ্রেস ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা হয়। প্রথমবার বেয়াই মাহবুবুর রহমানকে সাথে নিয়ে ওমরাহ ও যেয়ারতের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি পবিত্র মদিনা যাওয়া হয়। আমরা পবিত্র মদিনা হোটেলে এহরাম পরিধান করে বিমান বন্দর সড়ক ট্রেন স্টেশনে চলে যাই বেলা ১১ টার দিকে। ট্রেন স্টেশন পবিত্র মদিনা হুদুদে হারম তথা হারমের সীমানার বাহিরে। আমাদের টিকেটটি ছিল ইকোনোমি ক্লাস। মধ্যখানে লাইনে দু’দিকে দুই সিট করে। চায়নাতেও চড়ে অভিজ্ঞতা হয়েছে বুলেট ট্রেনের। কোচগুলো ছোট তথা যাত্রী ধারণ ক্ষমতা কম হয়ত নিরাপত্তার খাতিরে। এইবার হজের সময় ভাগিনা আসিফ আহমেদ তার মা ও স্ত্রীকে নিয়ে হজ্ব করতে যায়। হজ্ব কাফেলা এজেন্সী প্রদত্ত হোটেলের পার্শ্ববর্তী রুমে তারা ৩ জন অবস্থানরত। হজের আগে পরে আমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করছে ট্রেনে পবিত্র মদিনা যাওয়ার জন্য। আমি পরামর্শ দিলাম ইকোনোমি ক্লাস যথাযথ আরামদায়ক। বেশি টাকা দিয়ে বিজনেস ক্লাসের প্রয়োজন নেই। তবে কাফেলা প্রধানের সাথে আলাপ করে টিকেট কাটতে বলেছি ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে।

 

২ জুলাই মঙ্গলবার আমাদের কাফেলা এজেন্সীর হাজীগণ সকালে পবিত্র মক্কা থেকে পবিত্র মদিনা রওনা হবে। দৈনিক ৭/৮ টি ট্রেন রয়েছে। আসিফ ১২ টা ২০ মিনিটের ট্রেনের টিকেট কাটল যাতে ফজরের নামাজ পড়ে নাস্তা করার পর কিছুক্ষণ ঘুমানো যায়। সকাল ৮ টার দিকে এ কাফেলার হাজীরা বাসে পবিত্র মদিনা রওনা হচ্ছেন। আমরা ৪ জনের বড় বড় লাগেজ তাদের মোয়াল্লেম বাসে দিয়ে দেয়া হয়। আমরা সাড়ে ১০ টার পর হোটেলের সামনে থেকে ৩০ রিয়ালে টেক্সী নিয়ে রুসাইফা ট্রেন স্টেশনে চলে যাই। এখান থেকে শুধু পবিত্র মদিনা যাওয়া-আসা হয় মাত্র। জেদ্দা যাতায়াত গৌণ। নানান সুযোগ-সুবিধায় ভরপুর ট্রেন স্টেশনটি নিরিবিলি পরিবেশে। এখানে ট্রলিম্যান পাওয়া যায়। সেই লক্ষে একটি কোম্পানীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। গতবার পবিত্র মদিনা থেকে আসতেই ট্রলিসহ ট্রলিম্যানের কাউন্টারে টাকা জমা করতে হয়েছিল ১৭ রিয়াল। এইবারে ২৫ রিয়াল। দুই বারই ট্রলিম্যান বাংলাদেশী প্রবাসী। ট্রেন ছাড়ার ১ ঘণ্টা তথা ৬০ মিনিট আগে চেকিং শুরু হয়। আমরা চেকিং করে লিপ্টে উপরে চলে যাই। ট্রেন ছাড়ার ১০ মিনিট আগে লিপ্টে নেমে ট্রেনে আসন গ্রহণ করি। ট্রলিম্যান আমাদের লাগেজগুলো নিয়ে সহায়তা করে। দরজা দিয়ে প্রবেশ করেই থাকে বসায়ে দেয়। আমাদের দেশের ট্রেন ব্যবস্থাপনা ব্যতিক্রম। সিটের উপরেই লাগেজ রাখতে হবে। আর কোন ব্যবস্থা নেই। কিন্তু উন্নত বিশ্বের মত হারামাইন এক্সপ্রেসেও সিটের উপর ছোট ছোট লাগেজ রাখার ব্যবস্থা ত আছেই, দরজার পাশে দু’দিকে থাক দেয়া আছে বড় বড় লাগেজ রাখার জন্য।

 

গতবার পবিত্র মদিনা থেকে আসার সময় ইকোনোমি ক্লাসে আমাদেরকে কোন খাবার দেয়নি। হয়ত বিজনেস ক্লাসে খাবারের প্যাকেট দিবে স্বাভাবিক। এই বার দেখি ট্রেন ছাড়ার আগেই সিটের সামনে খাবারের প্যাকেট রেখে যাচ্ছেন ট্রেনের স্টাফ। এতে আইটেম হল মুরগি সমেত ভাত, সালাদ, মিষ্টান্ন আর পানির বোতল। আসিফ কিন্তু ট্রেনে খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত খাবার কিনে রেখেছিল। কিছুক্ষণের ব্যবধানে ট্রেনের ভিতর হাঁটাহাঁটি শুরু করি অভিজ্ঞতা লাভের জন্য। ট্রেনে মোট ১৩ টি কোচ। আমরা ইকোনিমি ক্লাসে ৪০/৪৫ সিট। বিজনেস ক্লাসে এর থেকে চার ভাগের এক ভাগ সিট কম হবে। পুরো ট্রেনে হেঁটে অভিজ্ঞতা লাভ করলাম। মধ্যখানে রেস্টুরেন্ট আমাদের দেশের মত কোচের ভিতর হেঁটে হেঁটে খাবার বিক্রি করে না। তথায় গিয়ে খাবার কিনে খেতে হয়। বিজনেস ক্লাসের ৪/৫ টি কোচ একদম ফাঁকা। প্রতি কোচে ৩/৪ জনের বেশি যাত্রী আছে মনে হয় না। ইকোনোমি ক্লাস অনেকটা পূর্ণ বলা যাবে। যথাসময়ে ট্রেন ছেড়ে দিয়ে জেদ্দা বিমান বন্দর স্টেশনে ৪ মিনিটের জন্য থেমেছে। এরপর নন-স্টপ পবিত্র মদিনা। ট্রেন ঘণ্টায় ২৯০-৩০০ কি.মি গতিতে চলতেছিল। যা সামনে স্ক্রিনে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। পবিত্র মদিনা স্টেশনে নেমেই নামাজ কক্ষে গিয়ে আমরা যোহরের নামাজ পড়ে নিই। কাফেলা এজেন্সী প্রধান পবিত্র মদিনা হোটেলের নাম ঠিকানা দেয়ায় আমরা ৫০ রিয়াল দিয়ে টেক্সীযোগে নির্দিষ্ট হোটেলের উদ্দেশ্যে চলে যাই। আমরা হোটেল কক্ষে লাগেজ রেখে মসজিদে নববীতে আসরের জামাত পড়ার সৌভাগ্য লাভ করি। তবে গতবার ক্রেডিট কার্ডে ১৭৫ রিয়াল বা কম বেশি দিয়ে টিকেট কাটা হয়। এইবারে ইকোনোমি কোচের মূল্য ২৭৫ রিয়াল।

 

কাফেলা প্রথা চালু হওয়ার আগে জেদ্দা হজ্ব টার্মিনালের সৌদি এয়ার লাইন্স কাউন্টার থেকে টিকেট কেটে এই হজ্ব টার্মিনাল থেকেই অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে গমন করা হয় একাধিক বার। তেমনিভাবে পবিত্র মদিনা থেকে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে জেদ্দাও আসা হয়। জেদ্দায় হজ্ব, সৌদি, বিদেশী এয়ার লাইন্সের তিন টার্মিনালে বাস কোম্পানীগুলো কাউন্টার খুলে, বাস ব্যবহার না করে থাকলে তাদের টাকা ফেরত দেয়ার জন্য। যেহেতু সৌদি হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় হজ্বের অনেক আগেই হজ্বযাত্রী থেকে টাকা নিয়ে বিভিন্ন খাতে খরচের মধ্যে বাস কোম্পানীগুলোকে টাকা দেবে স্বাভাবিক। বর্তমানকালেও এ সিস্টেমতা বহাল রাখা আবশ্যক। যাতে বাসের স্থলে ট্রেন বিমান ব্যবহার করলে বাসের টাকা ফেরত পাওয়া যায়। বস্তুত যুগের অবস্থার চাহিদার প্রেক্ষিতে হারামাইন এক্সপ্রেস ট্রেন যথাযথ। যেহেতু প্রতি বছর হজ্ব সিজনসহ ওমরাহ কার্যক্রম অতি সহজতর করা হয়েছে। ব্যাপক ওমরাহ ও যেয়ারতকারী দুই পবিত্র নগরীতে যাতায়াত করছে। ফলে সারা বছর উভয় পবিত্র নগরীতে হজ ওমরাহ যেয়ারতকারীর সমাগম থাকে। কাজেই আরামদায়ক যাতায়াতের জন্য হারামাইন এক্সপ্রেস ট্রেন সার্ভিস যথাযথ।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট