চট্টগ্রাম বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

পোশাকখাতের অস্থিরতা দূরীকরণে চাই সুচিন্তিত উদ্যোগ

মো. দিদারুল আলম

১৫ অক্টোবর, ২০২৪ | ১২:০৯ অপরাহ্ণ

তৈরি পোশাকখাতে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, অবিলম্বে এর অবসান হওয়া উচিত। এমনিতেই সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়, তার ওপর সম্প্রতি দেশে একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। এ সময় পোশাকশিল্পে অস্থিরতা বিদেশি ক্রেতাদের নেতিবাচক বার্তা দেবে এবং দিচ্ছেও তাই। ভুলে গেলে চলবে না, এ শিল্প দেশের প্রধান রপ্তানি খাত এবং আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। এ খাতকে তাই কোনোভাবেই অস্থিতিশীল হতে দেওয়া উচিত নয়। অথচ বেশ কিছুদিন ধরে এ শিল্প ঘিরে অসন্তোষ চলছে, নানা ধরনের দাবিদাওয়া জানাচ্ছে শ্রমিকরা।

 

অস্থিরতার প্রধান কারণগুলো হলো: বহিরাগতদের উসকানি, শ্রমিকদের দাবি ও ঝুট বাণিজ্য দখল নিয়ে দ্বন্দ্ব। জানা গেছে, ২০২৩ সালের মজুরি বৃদ্ধির পর অনেক কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটে, যাদের অধিকাংশ ছিলেন অভিজ্ঞ শ্রমিক। এসব শ্রমিকরা বেশিরভাগই আর কোথাও চাকরি পাননি। সরকার পরিবর্তনের পর তারাই কারখানাগুলোতে জড়ো হয়েছে চাকরি ফিওে পেতে। আবার কিছু কারখানায় জুলাই অগাস্টেও বেতন এখনো হয়নি, ফলে সেগুলোতেও শ্রমিকদের মধ্যে নতুন কওে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিলো, যার জেরে পুরো সেপ্টেম্বর জুড়েই বিক্ষোভ হয়েছে শিল্পাঞ্চলগুলোতে। অন্যদিকে, স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামীলীগের লোকজন নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর বিএনপির পরিচয়ধারী ব্যক্তিরা পোশাক কারখানার বড় বড় জোনগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরকার পতন এবং শ্রমিক অসন্তোষের জেরে বাংলাদেশের তৈরিপোশাকের ক্রয়াদেশের একটা অংশ প্রতিবেশি ভারতসহ বিভিন্ন দেশের বাজারে চলে যাবার ঘটনায় উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।

 

হাতছাড়া হওয়া কার্যাদেশগুলো বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশ ভারত, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া এবং পাকিস্তানে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিকে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতের জন্য গভীর সংকট হিসেবে দেখা হচ্ছে।বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ক্রেতা এবং বাংলাদেশের পোশাক কারখানার মধ্যে মধ্যস্থতাকারী একটি প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, সময়মতো শিপমেন্ট করতে না পারায় তাদের একটি ক্রেতার নব্বই শতাংশ ক্রয়াদেশ ভারতে চলে গেছে।বাংলাদেশের বড় বড় পোশাক কারখানা গড়ে উঠেছে এমন অঞ্চলের মধ্যে আশুলিয়া, সাভার এবং গাজীপুর এলাকায় সমস্যা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। শ্রমিক অসন্তোষ এবং উত্তেজনার এক পর্যায়ে যৌথবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে একজন শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।বাংলাদেশে পোশাক খাতে অস্থিরতার একাধিক কারণ সামনে আসছে।

 

এর মধ্যে ঝুট ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব, মালিকানার সমস্যা, বকেয়া পাওনা, কিছু ক্ষেত্রে বহিরাগতদের উসকানি এবং শ্রমিকদের নতুন কিছু দাবি দাওয়া এর পেছনে কাজ করেছে। আগের সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক নেতাদের ফ্যাক্টরিতে যেমন সমস্যা হয়েছে, তেমনি পাঁচই অগাস্টের পর সুযোগ পেয়ে শ্রমিকরাও নানা দাবি নিয়ে মাঠে নামে। ঝুট ব্যবসা নিয়ে একটা সমস্যা। আগে যারা ছিল তাদের জায়গায় নতুন লোকজন এই ব্যবসা নিতে চায়। এছাড়া কিছু বহিরাগত সমস্যা ছিল। আর আন্তর্জাতিক কিছুটা চাপ থাকেই। যারা চায় আমাদের দেশ থেকে এই শিল্পটা আরেক দেশে যেন চলে যায়।চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই ভালো যাচ্ছে না বাংলাদেশের। জুলাই জুড়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে নৈরাজ্য, সহিংসতা আর সংঘাতের পর কারফিউ জারি হয়। প্রথমবারের মত দীর্ঘ সময়ের জন্য ইন্টারনেট বন্ধের কবলে পড়ে সারা পৃথিবীর সঙ্গে দেশের বাণিজ্য যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এতে বিশ্ব বাজারে তৈরি হয় ‘আস্থার সংকট’।আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুৎ হলে হাল ধরেন মুহাম্মদ ইউনূস।

 

পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক থাকায় আশার আলো দেখেছিলেন পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। তবে আশার প্রদীপ নিভে যায় ক্ষমতার পালাবদলের পর আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে। বিভিন্ন শিল্প কারখানায় হামলা হয়। আর শ্রমিক অসন্তোষ যেন কফিনে ‘শেষ পেরেক’ ঠোকে। বিজেএমইএ ও পোশাক খাতের নেতারা বলছেন গত কিছুদিনে অন্তত ২৫টি কারখানা বন্ধ হয়ে পড়েছে। তবে এর মধ্যে কয়েকটি খোলার প্রক্রিয়া চলছে। যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয় আগামী দু’মাসে আরও কিছু কারখানা বন্ধ হওয়ারও আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।প্রতিযোগিতামূলক দেশগুলো এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে বা ক্রেতারাও তাদের দিকে ঝুঁকছে। রিজার্ভ সংকটের কারণে সময়মতো ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় ডলার না পেয়ে এলসি করাই কঠিন হয়ে পড়ে দেশের কারখানাগুলোর জন্য।অনেক প্রতিষ্ঠানই সময়মতো এলসি না করতে পেরে প্রতিশ্রুতি লিড টাইমে তাদের রফতানি পণ্য শিপমেন্ট করতে ব্যর্থ হন।

 

অনেককে আবার লিড টাইমের মধ্যে শিপমেন্ট করার জন্য এয়ার শিপমেন্টে বাধ্য হন। এতে রফতানি খরচ অনেকটাই বেড়ে যায় তাদের। মূলত গত বছর থেকে শুরু হওয়া এই সমস্যা আরও ঘনীভূত হয় চলতি বছরে।এদিকে পোশাকশিল্পে অস্থিরতার কারণে কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সময়মতো পণ্য জাহাজীকরণে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। তাছাড়া অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন বিদেশি ক্রেতারা, নতুন অর্ডার দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারেন তারা। সামগ্রিকভাবে পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। রপ্তানিমুখী এ শিল্পকে বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতা, শ্রমিক নেতা, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এ শিল্পে অস্থিরতার অবসান হবে না। এর প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে।

 

সরকারের নানামুখী উদ্যোগ সত্তে¡ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঘাটতি, ঝুটসহ কারখানা সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, কিছু কারখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তৎপরতা, বেতন ভাতা সংক্রান্ত সমস্যা এবং বাইরের ইন্ধনসহ বিভিন্ন কারণে পোশাক কারখানাগুলোতে অস্থিরতা বন্ধ হচ্ছে না। এখন যেভাবে হোক সব ধরনের অস্থিরতা বন্ধ করতে সরকারকে কঠোর হতে হবে। এখন আর সময় নেই। কারণ অর্ডার চলে যাচ্ছে। দেরি করলে এই শিল্প গভীর সংকটে পড়বে।অনতিবিলম্বে সমস্যাগুলো সমাধান করে কারখানাগুলো যাতে উৎপাদনে যেতে পারে সেই ব্যবস্থাই করতে হবে।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও কলেজ-শিক্ষক।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট