প্রায় চারশ বছর আগে এ অঞ্চলে মগ জলদস্যুদের ভীষণ উপদ্রব ছিল। বার্মা, অর্থাৎ আজকের মিয়ানমার থেকে আসা মগ জলদস্যুরা সে সময় বাংলাদেশের এক বিস্তীর্ণ এলাকায় রীতিমতো ত্রাসের রাজত্ব বানিয়েছিল। ফরাসি পরিব্রাজক বার্নিয়ের সে সময়ের মগদস্যুদের লুণ্ঠন ও অত্যাচারের যে বিবরণ দিয়েছেন, তা পড়ে এখনো রক্ত হিম হয়ে আসে। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম জয় করার পর মগদের সন্ত্রাসের রাজত্বের অবসান হয়। তবে মগদস্যুদের অত্যাচার-নির্যাতন ও লুটপাটকে আজো স্মরণীয় করে রেখেছে ‘মগের মুল্লুক’ প্রবাদটি। অরাজক পরিস্থিতি বোঝাতে বাংলায় বেশ জনপ্রিয় প্রবাদ ‘মগের মুল্লুক’। অরাজক পরিস্থিতিকে আজো ‘মগের মুল্লুকের’ সাথে তুলনা করা হয়। বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের সময়ে এ প্রবাদটি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। সে সময় সংগঠিত গুম, খুন, বিরোধী মত দমনের ঘটনাসহ বিভিন্ন বিষয়কে স্পষ্ট করতে ‘মগের মুল্লুকের’ কথা স্মরণ বা উচ্চারণ করা হতো। আওয়ামীলীগ সরকারদলীয় সাংসদ ও মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একদিন রেগেমেগে অভিযোগ করেছিলেন, দেশটা একদম ‘মগের মুল্লুক’ হয়ে উঠেছে। নারায়ণগঞ্জের সাত গুম-খুনের ঘটনায় আইন প্রয়োগকারীদের অকর্মণ্যতার দিকে আঙুল তুলে তিনি এমন মন্তব্য করেছিলেন। তিনি জাতীয় সংসদে বক্তব্য প্রদানকালে বলেছিলেন- মানুষ অভিযোগ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে যাচ্ছে, আর তারা বসে বসে হিসাব-নিকাশ করছে কার অভিযোগ নেবে, কারটা নেবে না। ‘এটা কি মগের মুল্লুক? এটা আইনের বরখেলাপ।’
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামীলীগ তথা শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। আমরা প্রবেশ করেছি নতুন বাংলাদেশে। আমরা আশা করেছিলাম সবধরনের অরাজক পরিস্থিতির অবসান হবে, একটি শান্তির বাতাবরণ তৈরি হবে। গুম, খুন, আয়নাঘরের অবসান হবে। অবসান হবে সবধরনের বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের। কিন্তু গুম, খুন, আয়নাঘরের অবসান হলেও দুঃখজনকভাবে বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের অবসান হয়নি। একের পর এক বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে চলেছে। এ যেন ‘মগের মুল্লুক’ থেকে ‘মবের মুল্লুক’ এর আলামত। এমন চিত্র অনভিপ্রেত, দুঃখজনক ও উদ্বেগের, সন্দেহ নেই।
উল্লেখ্য, বাংলার ভাষা ও ইতিহাসে ‘মগ’ শব্দটি অনেক প্রাচীন হলেও ‘মব’ শব্দটি খুব বেশি পুরোনো নয়। মব ট্রায়াল বা মব জাস্টিস হলো এমন এক সামাজিক আচরণ, যেখানে আইনের শাসনকে অগ্রাহ্য করে একটি বিক্ষুব্ধ জনতা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে অপরাধী বলে সন্দেহভাজন ব্যক্তির প্রতি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এটি একটি ভয়াবহ এবং অনাকাঙিক্ষত ঘটনা, যা সমাজে বিশৃঙ্খলা এবং ন্যায়বিচারের অভাবে ঘটে থাকে। বিশেষ করে যেসব সমাজে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা জনগণের আস্থা বিচারব্যবস্থার প্রতি কমে যায়, সেখানে মব ট্রায়াল বা মব জাস্টিসের ঘটনা বেড়ে যেতে দেখা যায়।
অপরাধবিজ্ঞানীদের মতে, মব জাস্টিসের পেছনে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক কারণ রয়েছে। যেমন- আইনের প্রতি আস্থার অভাব: বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, পুলিশি তদন্তের দুর্বলতা এবং বিচারব্যবস্থায় দুর্নীতি মব জাস্টিসের প্রধান কারণ। অপরাধীদের দ্রুত শাস্তি না পেলে জনগণের মধ্যে আক্রোশ জমে ওঠে। ভিত্তিহীন গুজব: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা প্রথাগত কথোপকথনের মাধ্যমে ভুয়া খবর বা গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যা উত্তেজনা সৃষ্টি করে। তৎক্ষণাত প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা: ক্ষুব্ধ জনগণ কোনো অপরাধের সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে নিজ উদ্যোগে শাস্তি দিতে চায়, যাতে তারা নিজেদেরকে ন্যায়বিচারক মনে করে। সামাজিক অস্থিরতা: রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, এবং পারিবারিক বা সম্প্রদায়গত দ্বন্দ্ব থেকেও মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বড় আকারে ‘মব জাস্টিস’ শুরু হয়। যদিও বাংলাদেশে মব জাস্টিসের প্রবণতা আগেও দেখা গেছে। তবে তা ছিল কথিত চোর-ডাকাতকে গণপিটুনি দেওয়ার ঘটনা। কিন্তু এবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা কর্মকর্তাদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা, মারপিট করে তাড়িয়ে দেওয়া, আদালত এলাকায় আসামিদের ওপর হামলা, কোথাও কোথাও পিটিয়ে, কুপিয়ে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করাও বিভিন্ন জেলা সফর করতে গিয়ে কোথাও কোথাও প্রতিরোধ ও বিক্ষোভের মুখে পড়ছেন। বগুড়ায় তারা সমাবেশ করতে গিয়ে পুলিশ ও সেনা পাহারায় সমাবেশ না করেই ফিরে আসতে বাধ্য হন। এরকম ঘটনা আরও কয়েকটি জেলায় ঘটেছে। গত ৮ সেপ্টেম্বর বগুড়ায় আদালত চত্বরে হামলার শিকার হয়েছেন আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ এনে কয়েকজন যুবক এই হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন হিরো আলম। হামলার প্রতিক্রিয়ায় হিরো আলম বলেন, ‘এক স্বৈরাচারের পতনের পর আরেক দল নিজেদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শুরু করেছে।’ একই দিনে রাজশাহীতে পিটিয়ে হত্যা করা হয় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, পঙ্গু আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে। আট বছর আগে আরেক হামলায় তিনি একটি পা হারান। তারপর থেকে তিনি প্লাস্টিকের পা লাগিয়ে চলাফেরা করতেন। সেদিন তিনি ওষুধ কিনতে বের হয়েছিলেন। ৫ আগস্ট ছাত্রদের ওপর হামলার অভিযোগ তুলে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল নামের এক যুবককে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। তোফাজ্জলের মামাতো বোন বলেছেন, ‘তোফাজ্জল মানসিক রোগী ছিলেন। এর আগে গত ১৭ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে যে সহিংসতা শুরু হয়েছিল তা এখনো চলছে। এখনো মানুষের মধ্যে সহনশীলতা ফিরে আসেনি। সুযোগ পেলেই মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। চলতি বছর ১৫ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ৩৩ জনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশের ভাষ্য মতে, সামাজিক অস্থিরতার কারণে গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে চলেছে। তুচ্ছ কারণে মানুষ সংঘর্ষে জড়িয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশকেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, গত সাড়ে ৬ বছরে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ২৮৬ জন। এর মধ্যে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৩৯ জন, ঢাকায় নিহত হন ২১ জন। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে সর্বোচ্চ ৬৫ জনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়, ঢাকায় নিহত হন ২২ জন। তবে ২০২০ খ্রিস্টাব্দে নিহতের সংখ্যা কমে ৩৫ জন হয়েছিল, ২০২১ খ্রিস্টাব্দে এই সংখ্যা ছিল ২৮ জন, ২০২২ খ্রিস্টাব্দে ৩৬ জন নিহত হন। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগের বছর ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে নিহতের সংখ্যা বেড়ে হয় ৫১ জন। ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনের পর গত ৭ মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) গণপিটুনিতে নিহত হন ৩২ জন। দেশে গত দুই মাসে ৩৫ জনকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মামলায়ও বাছবিচার না করে গণহারে আসামি করা হচ্ছে। আর পতিত সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা আটক হতে শুরু করার পর আদালত এলাকায় পুলিশের উপস্থিতিতেই তাদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। তাদের পিটিয়ে রক্তাক্তও করা হয়। এই হামলা থেকে নারীরাও রেহাই পাননি। মানবাধিকার কর্মীদের দাবি, পুলিশের দুর্বলতা এবং তদন্তে ঘাটতির কারণে এসব গণপিটুনি ও গণমামলা থামানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে, পুলিশ প্রতিটি ঘটনা গুরুত্বসহ নিয়ে বিচারের আওতায় আনার আশ্বাস দিয়েছে। উল্লেখ্য, মব ট্রায়াল বা গণপিটুনি মৌলিক অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বাংলাদেশের সংবিধানে, অপরাধী-নিরপরাধী নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিককে আইনের আওতাও বিচার লাভ এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের সকল নাগরিক আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। অনুচ্ছেদ ৩১ বলছে আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনামে বা সম্পত্তির হানি ঘটে। অনুচ্ছেদ ৩৩ অনুযায়ী একজন ব্যক্তির অবশ্যই তার মনোনীত আইনজীবীর সাথে পরামর্শ এবং নিজেকে সমর্থন করার অধিকার রয়েছে। অনুচ্ছেদ ৩৫ অনুযায়ী আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না এবং অপরাধের জন্য যতটুকু শাস্তি প্রাপ্য তার চেয়ে বেশি বা ভিন্ন কোনো শাস্তি দেয়া যাবে না। এছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী, অপরাধী ধরা পড়লে তাকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করতেই হবে। এর ব্যতিক্রম করলে দ-বিধির ১৮৭ ধারা অনুযায়ী অনূর্ধ্ব ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। আটক রাখার পর যদি ওই ব্যক্তিকে সামান্য আঘাতও করা হয় তাহলে ৩১৯ ধারায় উল্লিখিত আঘাতের অপরাধে অপরাধীকে ৩২৩ ধারার অধীনে এক বছরের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদ- অথবা ১০০০ টাকা জরিমানা করা যাবে। যদি পিটুনি দেয়া হয় তবে কারাদণ্ডের মেয়াদ বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে অনূর্ধ্ব তিন বছর এক মাসে। সেইসঙ্গে অনূর্ধ্ব ৫০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে। যদি ইচ্ছাকৃতভাবে গুরুতর আঘাত দেয়া হয় তবে ৩২৫ ধারার অধীনে সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা যায়। এছাড়া দণ্ডবিধির ৩৩৫ ধারা অনুযায়ী কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড উভয় দণ্ডে ও দণ্ডিত হতে পারেন আঘাতকারীরা। হামলা চালানোর ফলে যদি ব্যক্তির মৃত্যু হয় তাহলে দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারা অনুযায়ী দশ বছরের কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডের সাজা দেয়া যায়। আর যদি অপরাধীকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মেরে ফেলার বিষয়টি প্রমাণিত হয় তবে শাস্তি হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব দশ বছর মেয়াদের যে কোনো কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড। গণপিটুনিতে ওই ব্যক্তি নিহত হলে দণ্ডবিধির ৩৪ ধারা অনুযায়ী গণপিটুনিতে অংশ নেয়া সব ব্যক্তি সমানভাবে এজন্য দায়ী হবে। কেননা আইনে ‘যৌথ দায়িত্বশীলতা’ বলে একটি নীতি আছে। সেখানে বলা হয়েছে, একই অভিপ্রায় নিয়ে একাধিক ব্যক্তি কোনো অপরাধ সংঘটন করলে, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তি এমনভাবে দায়ী হবেন যেন তিনি নিজেই অপরাধটি করেছেন।এর মানে গণপিটুনিতে যারাই অংশ নেবেন সেটা আদালতে প্রমাণ করা গেলে সবারই শাস্তি নিশ্চিত করার সুযোগ আছে। এক্ষেত্রে কেউ বড়ধরনের জখম করলেও যে শাস্তি পাবেন, একজন সামান্য ধাক্কা দিলেও একই শাস্তির আওতাভুক্ত হবেন। এছাড়া গণপিটুনিতে যদি কেউ মারা যায় আর সেটা যদি খুন হিসেবে আদালতে প্রমাণ করা যায় তাহলে দণ্ডবিধি- ১৮৬০ এর ২৯৯ ধারায় উল্লিখিত খুনের অপরাধে অপরাধীকে ৩০২ দ্বারার অধীনে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং জরিমানা দণ্ডে ও দণ্ডিত করা যায়। সে হিসেবে আদালতে গণপিটুনিতে হত্যা প্রমাণিত হলে আইনানুযায়ী সবারই ন্যূনতম দণ্ড হবে ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রেও মব ট্রায়ালকে মানবতাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা-১৯৪৮, এর তিন নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে প্রত্যেকের জীবন, স্বাধীনতা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার আছে। অর্থাৎ একজন মানুষ সুস্থ স্বাভাবিকভাবে তার জীবন যাপনের অধিকার রাখেন। অনুচ্ছেদ পাঁচ অনুযায়ী, কারো প্রতি নির্যাতন, অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ করা যাবে না।
কিন্তু মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে আইনের এতো কঠোর অবস্থানের পরও দুঃখজনকভাবে দেশে মব ট্রায়াল বন্ধ হয়নি, উপরন্তু একের পর এক এমন পৈশাচিক কাণ্ড ঘটে চলেছে কিছু মানুষরূপী অমানুষের দ্বারা। যা জনমনে হতাশা ও আতংক তৈরি করছে, বহিবির্শ্বে বিনষ্ট করছে দেশের ভাবমূর্তি। এমন পরিস্থিতি উদ্বেগকর। এটি কোনো মতেই কাম্য নয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং মানবিক চেতনাধারী সব মানুষই এই অমানবিক ও সভ্যতাবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চারকণ্ঠ। বর্তমানে যেহেতু জনগণের আকাঙ্ক্ষার একটি সরকার কাজ করছে, তারা প্রধানত গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর; সেহেতু আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার পেছনে কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিকে আইনের কাছে সোপর্দ করা যায়। কিন্তু তা না করে হঠাৎ কতিপয় ব্যক্তি যখন কারো উপর গণপিটুনি শুরু করে দেয়, তখন বুঝতে হবে, এর পেছনে অন্য মতলব আছে। তখন এমন অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে জনগণের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে। আমরা মনে করি, যত দ্রুত সম্ভব মব জাস্টিসের মতো অপকর্ম নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। অতি দ্রুত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং পরিবার ও সমাজে মানবাধিকার সংস্কৃতি বিকাশে রাষ্ট্রের সহায়ক ভূমিকা পালন অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। আমরা আশা করব, ছাত্র-জনতার আকাক্সক্ষার প্রতিচ্ছবি অন্তর্বর্তী সরকার মব ট্রায়াল রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। আর কারো পরিবারে নেমে আসবে না বিষাদের ছায়া।
পূর্বকোণ/পিআর