চট্টগ্রাম বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

মার্কিন নির্বাচন : যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক সময়

ওয়াহিদ জামান

৩০ জানুয়ারি, ২০২৪ | ৭:০৫ পূর্বাহ্ণ

২০২৪ সালে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ নির্বাচনে ভোট দিতে যাচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলো নির্বাচনে যাবে। ভারত, বাংলাদেশ (ইতোমধ্যে নির্বাচন হয়ে গেছে), ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, মেক্সিকো এবং যুক্তরাজ্য সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচনের দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। যাই হোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নভেম্বর-২০২৪ এর নির্বাচন সম্ভবত সবচেয়ে অনিশ্চিত এবং তার নাগরিকদের জন্য তো বটেই, সমগ্র বিশ্বের জন্যও অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করতে চলেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী দু’জনেরই বয়স ৮০ বছরের কাছাকাছি। বর্তমান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন ৫০ বছর আগে প্রথম কংগ্রেসে প্রবেশ করেছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ৩০ বছরেরও আগে একজন প্রপার্টি ডেভেলপার, ব্যবসায়ী এবং তারপর একটি টেলিভিশন রিয়েলিটি শো হোস্ট হিসেবে বিখ্যাত হয়েছিলেন। পরে প্রেসিডেন্ট হন।

এখন চমকপ্রদ সত্যটি হলো- নানা জরিপে দেখা যাচ্ছে যে, বেশিরভাগ আমেরিকানই চায় না যে বাইডেন বা ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুন। উভয় প্রার্থীকে নিয়েই উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক ধারণা জন্মেছে জনগণের মনে। তাছাড়া বয়সটাও তাদের অনুকূলে নেই। এ ব্যাপারটা অন্যান্য উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর সম্পূর্ণ বিপরীত। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও ইতালির নেতাদের বয়স ৪০ এর ঘরে এবং স্পেনের ৫০ এর কাছাকাছি। জার্মানি ও জাপানের নেতারা বাইডেন ও ট্রাম্পের তুলনায় ইতিবাচকভাবে তরুণ (৬০ এর ঘরে)।

তাহলে আমেরিকান নির্বাচকমন্ডলী কেন অস্বস্তিতে? আর এ বছর নভেম্বরে নির্বাচনের সম্ভাব্য পথ কী এবং এর সম্ভাব্য পরিণতি কী?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি গভীরভাবে মেরুকৃত সমাজ, যেখানে একটি দলের প্রতি আনুগত্য রাজনৈতিক পছন্দের পরিবর্তে নানা গোত্রীয় সংযুক্তির বিষয় হয়ে উঠেছে। রিপাবলিকান পার্টি তার প্রার্থী বাছাই করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প সহজেই আইওয়া এবং নিউ হ্যাম্পশায়ারে প্রথম প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করেছেন। যদিও তার একমাত্র অবশিষ্ট প্রতিদ্ব›দ্বী জাতিসংঘের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি দৌড়ে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। রিপাবলিকান মনোনয়ন দৌড়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনও জনপ্রিয়। আমেরিকান গণতন্ত্রের জন্য এটি সত্যিই বিস্ময়কর এবং উদ্বেগজনক ঘটনা যে কর ফাঁকি, বিদ্রোহ, নির্বাচনী হস্তক্ষেপ এবং যৌন নিপীড়নসহ ৯১টিরও বেশি ফৌজদারি অভিযোগ, দু’বার অভিশংসিত একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এখনও এই অবস্থানে থাকতে পারেন! প্রতিটি ফৌজদারি অভিযোগের সাথে তার জনপ্রিয়তা এবং রিপাবলিকান ভোটারদের ওপর তার দখল যেন আরও শক্তিশালী হয়েছে।

মার্কিন আইনের অধীনে, এমনকি যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প নভেম্বরের আগে আরও অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন, তবুও এটি তাকে রাষ্ট্রপতি পদে লড়তে বাধা দেয় না। প্রকৃতপক্ষে অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পকে রাষ্ট্রপতি হতে বাধা দেওয়ার জন্য কোনও আনুষ্ঠানিক আইনি বাধা নেই।
অন্যদিকে, অর্ধেকেরও বেশি মার্কিন ভোটার বলেছেন যে ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন, তবে তিনি ‘রাষ্ট্রপতি হওয়ার উপযুক্ত’ হতে পারবেন না। একাধিক চলমান ফৌজদারি বিচার এবং নির্বাচনের আগে একাধিকবার দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সাংবিধানিক সংকটের হুমকি খুবই বাস্তব। আমাদের কাছে যদিও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের চলমান কাহিনী রয়েছে।

এদিকে, নির্বাচনের বছরের এই জানুয়ারিতে এসে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মতো অজনপ্রিয় কোন রাষ্ট্রপতি কখনও ছিলেন না। ৩০ বছরের কম বয়সী অধিকাংশ ডেমোক্রেট চায় না যে তিনি আবার প্রতিদ্ব›িদ্বতা করুন এবং সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ডেমোক্রেটদের পছন্দের সুযোগ দিলে আসন্ন নির্বাচনে তারা তাদের নতুন ‘প্রতিনিধি’কে সমর্থন দেবেন। গাজার জনগণের ভয়ানক দুর্ভোগের প্রতি জো বাইডেনের আপাত উদাসীনতা তাকে তরুণ গণতন্ত্রী এবং আরব-আমেরিকানদের মধ্যে অজনপ্রিয় করে তুলেছে।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যদি নভেম্বরের পরিবর্তে আজ অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে ডোনাল্ড ট্রাম্প জো বাইডেনকে পরাজিত করে রাষ্ট্রপতির পদ ফিরে পাওয়ার একটি শক্তিশালী সম্ভাবনা রয়েছে। জো বাইডেন এবং ডেমোক্রেটদের ভাগ্য সত্যিই ভালো যে অনেক প্রতিক‚ল হাওয়া সত্তে¡ও এখনও বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে গতিশীল এবং সফল অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই রয়ে গেছে। শিল্পোন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই রয়েছে সর্বোচ্চ বৃদ্ধির হার এবং মুদ্রাস্ফীতিও দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে (গত মাসে মুদ্রাস্ফীতি বছরে ৪% এর কম ছিল)। কাঠামোগত সুবিধাগুলোর মধ্যে দেখা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান ‘কর্মক্ষম জনসংখ্যা’ রয়েছে (চীন এবং জাপানের বিপরীতে)। রয়েছে এমন একটি প্রতিরক্ষা বাজেট, যা পরবর্তী ৯টি বৃহত্তম দেশের সমন্বিত বাজেটের সমান। তাছাড়া শীর্ষ ১০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৮টিই রয়েছে এ দেশে (বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক সমীক্ষার অধীনে)।

মার্কিন ডলার এখনও বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৮০%-এর বেশি পছন্দের মুদ্রা এবং মার্কিন প্রযুক্তি শিল্প বিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল ও মূল্যবান রয়ে গেছে। যেখানে ৫টি বৃহত্তম মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানির বাজার মূলধন জার্মানি, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় ১০০ কোম্পানির সম্মিলিত বাজার মূলধনের চেয়ে বেশি।
তাহলে কেন মার্কিন নির্বাচকমন্ডলী এতটা হতাশাগ্রস্ত, বেশিরভাগ জরিপে ৫০% এরও বেশি অংশগ্রহণকারী বলেছেন যে দেশ ‘ভুল পথে’ আছে এবং তারা তিন বছর আগের চেয়ে আজ খারাপ অবস্থায়?
এই প্রশ্নের কোন সহজ উত্তর নেই। আমি বিশ্বাস করি যে একটি নীরব রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক মেরুকরণ তীব্র হয়েছে, যার ফলে বেশিরভাগ রিপাবলিকান বিশ্বাস করে ২০২০ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে একটি ত্রুটিপূর্ণ ফলাফলের সাথে উল্লেখযোগ্য অনিয়ম হয়েছে (যদিও এই দাবিকে সমর্থন করার জন্য একেবারেই আনুষ্ঠানিক প্রমাণ নেই)।
আর প্রকৃত অর্থনৈতিক বাস্তবতাটি হলো- শহুরে শিক্ষিত পরিবারগুলো স্বল্প শিক্ষিত এবং নিম্নআয়ের পরিবারের তুলনায় অনেক ভালো কাজ করার কারণে বৈষম্য আরও গভীর হচ্ছে। উপরন্তু শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য মজুরি মূল্যস্ফীতির সাথে তাল মিলিয়ে চলছে না। জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কর্মহীনতা সবাইকে উদ্বিগ্ন করছে। কংগ্রেসের মধ্যে স্থবিরতা ক্রমশঃ দৃশ্যমান হচ্ছে। বার্ষিক বাজেট অনুমোদনের ক্ষেত্রে এটা বেশ বোঝা গেছে। বস্তুত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন বিরাজ করছে বিষণ্ন এবং হতাশাজনক পরিবেশ, যেখানে দ্ব›দ্ব এবং অনিশ্চয়তাই একমাত্র সত্য।
বাদবাকি বিশ্বে এর প্রভাব পড়বেই। যেহেতু অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতে হবে আগামী সরকারগুলোকে। তাই জলবায়ু পরিবর্তন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিংবা ডিজিটাল মুদ্রার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার মতো বৈশ্বিক উদ্যোগগুলোয় দেশটির তেমন সাড়া হয়তো মিলবে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি নির্ভরযোগ্য ভ‚-রাজনৈতিক অংশীদার হওয়ার সম্ভাবনাও কমে আসছে। কারণ বিগত ৬০ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থানীয় অভিজাতদের অনেক স্বীকৃত বিশ্বাস ক্রমশঃ ম্লান হয়ে যাচ্ছে এবং এর ফলে অশান্তি মার্কিন নীতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। তবুও আমি বিশ্বাস করি, অবশেষে শান্তির আশা আছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অতীতে প্রচুর অস্থিরতা এবং পরিবর্তনের সময়কাল অতিক্রম করেছে, যেখানে বিশৃঙ্খলা আসন্ন বলে মনে হয়েছিল। ১৯৬০ এবং ৭০-এর দশক ছিল ভিয়েতনামের সাথে এমন একটি সময়, নাগরিক অধিকার আন্দোলন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে উত্তেজনাপূর্ণ প্রতিযোগিতা। যাই হোক, আমি বিশ্বাস করি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি দৃঢ় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা সরকারি নীতিতে স্থিতিশীলতা এবং জনসাধারণের হিত কামনা করে। যদিও সেই শাসক নীতিতে ফিরে আসতে সময় লাগবে এবং রূপান্তরটি হবে জটিল।
শেষ পর্যন্ত এই বছরের নির্বাচনে মার্কিন নির্বাচকমন্ডলী যে কঠোর পছন্দের মুখোমুখি হয়েছে তা নির্ধারণ করবে এই পরিবর্তন কতটা কঠিন হবে। জো বাইডেন বা ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি হবেন কিনা তার চ‚ড়ান্ত উপসংহারে যাওয়ার চেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ নির্বাচন চলাকালীন পরিবেশ এবং নির্বাচনের পরে রাজনৈতিক আচরণের সিদ্ধান্ত।
স্থিতিশীলতা এবং সভ্যতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাকি বিশ্বের জন্য ভালো হবে। ক্রমাগত অশান্তি কারও জন্য শুভ হবে না। শেষ পর্যন্ত ‘সমস্ত রাজনীতি স্থানীয়’ প্রবাদটি এখানে প্রযোজ্য। মানে আন্তর্জাতিক মঞ্চে মার্কিন আচরণ তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং অর্থনীতির মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হবে।
[অনুদিত]

লেখক :সিইও, ডব্লিউএন্ডএ কনসাল্টিং : প্রাক্তন প্রধান কৌশলী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা হারশে (Hershey), ফার্মার ব্রাদার্স’র পরিচালনা পরিষদের সদস্য। এছাড়াও ‘ফরচুন ফাইভ হানড্রেড’ কোম্পানির বেশ ক’টি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। বর্তমানে উদ্যোক্তাদের পরামর্শ আর সিনিয়র এক্সিকিউটিভদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট