চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৪

সর্বশেষ:

নারীর প্রতি সহিংসতা: কারণ ও প্রতিকার

সৈয়দা সারওয়ার জাহান

৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ | ৭:৪১ অপরাহ্ণ

নারীকে নিয়ে যত কথা, কবিতা, গান, গল্প, বাণী, উক্তি চারপাশে ছড়িয়ে আছে, পুরুষকে নিয়ে তেমন খুব বেশি কিছু পাওয়া যায় না। পুরুষকে নিয়ে কোন উক্তি করতে গেলে সেখানে নারী প্রসঙ্গ কোন না কোনভাবে এসে যায়।

প্রত্যেক সফল কীর্তিমান কৃতিপুরুষের জীবনের সাফল্যের পেছনে কোন নারীর অবদান নিহিত থাকে, যা পর্দার আড়ালে থাকে, সে নারীর সাফল্যের জয়মাল্য পরা হয় না, নারীর আত্মত্যাগের ফলে পুরুষের রাজকপালে জয়টীকা পরে। যুগে যুগে এ সত্যটির বহির্প্রকাশ ঘটেছে সফলপুরুষের স্বীকারোক্তি থেকে এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে। নারীরা নিজেদের অবস্থানগত কারণে তাদের করণীয়গুলোকে স্বীয় সত্তার সাথে একীভূত করে নেয়, একান্ত আপন করে কাজগুলো করে, যা শুধু নারীর কর্তব্য পালনের মধ্যে গণ্য হয় না, বরং নারীর অস্তিত্বের সাথে দেদীপ্যমান হয়ে উঠে। সময়ের পরিক্রমায় নারীর অবদানের মূল্যায়ন হয় না।

মূল্যায়ন বা প্রাপ্তির জন্য নারীকে হাহাকার করতেও দেখা যায় না। বরং বাস্তবতার নিরিখে কাজের স্বীকৃতি দেয়া হবে না বা মূল্যায়ন করা হবে না এধরণের প্রত্যাশাই থাকে নারীর। নারীরা ঘরের কাজ, সন্তান লালন পালন, পরিবারের সকলের জন্য কম-বেশি দায়িত্ব পালন করে থাকেন। পুরো সংসার কাঠামোটাকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে রাখার জন্য নিজের যোগ্যতা, মেধা, সক্ষমতা, বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে এ দায়িত্ব পালন করেন। নারীর এ কাজকে কখনো আর্থিক মূল্যায়ন করা হয় নি। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক দারিদ্র্য উন্নয়ন কৌশলপত্রে নারীদের গৃহস্থালি শ্রমকে অর্থনৈতিকভাবে মূল্যায়নের কথা বলা হচ্ছে।

বিষয়টি কিভাবে হতে পারে, তার একটি রূপরেখাও তুলে ধরা হয়েছে। যার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, দাতা সংস্থা, উন্নয়নকর্মী, গণমাধ্যমের প্রতিনিধি সকলের কাছে কিছু তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে দেশ, জাতি ও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নারীর অবদান মূল্যায়ন করা হয়নি, মূল্যায়ন করার জন্য চিন্তা করা হচ্ছে যা দুর্ভাগ্যজনক।

গৃহস্থালি বা ঘরের কাজের বাইরে নারীরা কৃষিকাজে শ্রম দেয়। কৃষকদের জমির ফসল ফলানোর জন্য যে কাজগুলো করতে হয় তন্মধ্যে অধিকাংশ কাজ কৃষাণীকে করতে হয়। আবার গৃহস্থালী কাজ, ঘরের রান্নাবান্না সহ ছেলেমেয়েদের কাজও করতে হয়। অকৃষিকাজ এবং অন্যান্য শ্রমনির্ভর কাজ ও নারীকে করতে হয়। অফিস- আদালতে ছোট-বড় দায়িত্ব পালন, শিল্প-কারখানায় বা নির্মাণকাজে শ্রমিকের কাজ করা, গার্মেন্টসে কাজ করা সবক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ প্রত্যক্ষ করা যায়।

আগে বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বা করপোরেট অফিসে উচ্চশিক্ষিত নারীরা অংশগ্রহণ করতেন, কিন্তু বর্তমানে স্বল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত নারীরা ড্রাইভিংসহ হাটে-বাজারে ছোট-খাট ব্যবসা পরিচালনায় অংশগ্রহণ করেন। এতকিছু করার পরে ঘরে ফিরার পরে কোথাও কোন ত্রুটি বিচ্যুতি হলে দোষারোপ করা হয় নারীকে। ঘরে বাইরে সবকিছু সামাল দিতে গিয়ে যদি সময়মতো খাবারটা দিতে না পারে বা খাবারের মান যদি খারাপ হয় সেটা নিয়ে যেমন কথা শুনতে হয় তেমনি কিশোরী মেয়েটি যদি কোন ছেলের সাথে মেলামেশা করে সেটার দায়িত্বও কিন্তু নিতে হয় মাকে। আবার মেয়ে আর ছেলে যদি মেলামেশা করে তার দোষারোপও করা হয় মেয়েকে। ছেলের অভিভাবক ছেলেকে শাসন না করে বরং মেয়ের অভিভাবককে অভিযোগ করে।

ফলশ্রুতিতে, মেয়ের ওপরে নেমে আসে তিরস্কার, অত্যাচার, নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল। একসময়ে মেয়ের চলাফেরা সীমিত হয়ে যায়। পরিণতিতে, অল্পবয়সে বিয়ে দিয়ে মা-বাবা ভারমুক্ত হয়ে যায়। এ ধরণের ঘটনা যখন তীব্র আকার ধারণ করে মেয়ে তখন আত্মহত্যার পথও বেছে নেয়।

অকালে বিয়ে হলে সেখানে ও জা-শাশুড়ি, ননদদের খুঁত ধরা, কটাক্ষ করা থেকে শুরু করে মানসিক নির্যাতন এমনকি শারীরিক নির্যাতন পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এখানেও অতিষ্ঠ হয়ে মেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। প্রায় দিনই পত্রিকার পাতা খুললে এ ধরনের ঘটনার খবর দেখা যায়। যেমন: স্বামী বিদেশে, দেবর, ননদ, শাশুড়ির অত্যাচার, যৌতুকের দাবিতে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা, স্বামীর সাথে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে আত্মহত্যা, বাপের বাড়ি থেকে ঈদুল আযহাতে গরুর পরিবর্তে ছাগল দেওয়াতে কথা কাটাকাটির জেরে আত্মহত্যা- এ ঘটনাগুলো ঈদুল আযহার পরের কয়েকদিনের মধ্যে পত্রিকার সংবাদ হতে দেখে বললাম। এছাড়া আরও অনেক ঘটনা বিভিন্ন কায়দায়, বিভিন্ন উপায়ে নারীকে ভিকটিম করে আত্মহননের দিকে ঠেলে দেয়, অথবা একেবারে মেরে ফেলার ঘটনা অহরহ ঘটছে।

চাঞ্চল্যকর অনেক ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও হয়েছে। আবার অনেক ঘটনা চাপা পড়ে গেছে এবং যাচ্ছে। ১৯৮৯ সালে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ সাংবাদিক নাজিম উদ্দীনের কন্যা শারমিন রিমাকে হত্যা করে তার স্বামী মুনির হোসেন। মুনির হোসেন পরকীয়ার কারণে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটায়। অপরাধের শাস্তি অবধারিতভাবে সে পেয়েছে, মুনির হোসেনের ফাঁসি হয়েছে, দেশবাসী এ বিচার প্রত্যক্ষ করেছে।

এ দৃষ্টান্তের পর যারা অপরাধজনক নারীহত্যা করার চিন্তা করে তাদের অবদমন হওয়াটা বিচারিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবং সামাজিকভাবে কাম্য। কিন্তু তা না হয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে চলেছে। প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানই নির্মম হত্যাকাণ্ডের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ১৯৭৬ সালে স্বাধীনতা উত্তরকালে শহীদ নাজিবুর রহমানের কন্যা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষবর্ষের ছাত্রী নিহার বানুকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আহমেদ হোসেন বাবু ও তার বন্ধু মিন্টু, নিলু, আহসানুল হক সহ কয়েকজন মিলে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

মামলার রায়ে ফাঁসির আদেশ হয় বাবুর, নীলুর ফাঁসি কার্যকর হয়। কিন্তু বাবু দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। একই সময়ে আরও একটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড ইকবাল কর্তৃক সংঘটিত হয়। সে তার স্ত্রী সালেহাকে হত্যা করে কাজের মেয়ের সাথে অনৈতিক সম্পর্কের প্রতিবাদ করায় বিচারে ডা. ইকবালের ফাঁসি হয়েছিল। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন এবং জনসচেতনতায় অপরাধীদের অপরাধ চাপা পড়ার সুযোগ পায়নি। পরিণতিতে শাস্তি কার্যকর হয়েছিল।

কালকিনির নীতুমন্ডল হত্যা, কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিপার হত্যা, দর্জি দোকানের কর্মচারী ওবায়দুল প্রেমে প্রত্যাখ্যান হয়ে রিপাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে, নীতুমন্ডলকে প্রতিবেশী মিলন মন্ডল হত্যা করে প্রেমে প্রত্যাখ্যান হয়ে।

বর্তমানে এটি বিচারের অপেক্ষায় আছে। বর্তমানে এধরণের হত্যাকাণ্ডের প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা, এস পি বাবুল আকতারের স্ত্রী মাহম্মদা খাতুন মিতু হত্যা, ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা নারীর প্রতি সহিংসতার চরম উদাহরণ।

কোন সময় ভালো লাগার কারণে প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হলে, কোন সময়ে নিজের অমতে বিয়ে করতে হলে, কোন সময় পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে, কোন সময় যৌতুকের কারণে, কোন সময় অন্য নারীর প্রতি আসক্তির জন্য স্ত্রীর প্রতি সহিংস আচরণ করছে পাষণ্ড স্বামী। মানুষের মনস্তত্ত্ব এত বিকৃত কেন হবে, এর সমাধানের উপায় কি এ বিষয়গুলো বিভিন্ন সময়ে অনেক বিজ্ঞ পন্ডিত ব্যক্তিগণ নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণ করে অভিমত ব্যক্ত করেন। আইনের প্রয়োগও হয়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। অপরাধী অপরাধ করে যদি কোন ফাঁক ফোকরে ছাড়া পেয়ে যায় তখন অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়।

লেখক: সৈয়দা সারওয়ার জাহান, চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব), বাংলাদেশ রাবার বোর্ড।

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট