চট্টগ্রাম বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫

সর্বশেষ:

মতামত

প্রয়োজন নির্বাচন পদ্ধতির আমূল সংস্কার

ডা. মো. সাজেদুল হাসান

১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ৫:১৭ পূর্বাহ্ণ

নদী পলিতে ভারী হয়ে গেলে তার নাব্যতা হারায় তখন পানির প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে উপকূল ছাপিয়ে লোকালয় বন্যাক্রান্ত হয়। সেটি নিরসনে নদী সংস্কারের প্রয়োজন পড়ে। তেমনি একটি সমাজ বা রাষ্ট্র যখন দুর্নীতিগ্রস্ত হয় তখন সে তার স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়ে ফেলে, অনিয়ম চতুর্দিকে শাখা প্রশাখা মেলে। সেই রাষ্ট্র বা সমাজে তখন সংস্কার অবশ্যম্ভাবী। যেই পরিবর্তন ও দিনবদলের আকাক্সক্ষা নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মানুষের সেই প্রত্যাশা পূরণে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে। আমরা আসলে সেই অসম্পূর্ণ বিপ্লবের রোমান্টিক চেতনায় আচ্ছন্ন ছিলাম, বিপ্লব পরবর্তী পুনর্গঠনের জন্য মানসিক, চারিত্রিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। ফলে জাতীয় ঐক্য যেটি উন্নয়ন অগ্রযাত্রার প্রাথমিক শর্ত সেটি ব্যাহত হয়।

মুক্তিযুদ্ধের পর নব্বই সালের গণঅভ্যুথানের মাধ্যমে সেই সুযোগ আবার এসেছিল। কিন্তু আমাদের উপলব্ধিহীনতায় শুধুমাত্র নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ থাকলাম। ফলস্বরূপ একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হয়তো পাওয়া গেছে। কিন্তু এর অন্তঃসারশূন্যতা ও পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাসের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকলাম। পরিণতিতে বিশ্বের অনেক গণতান্ত্রিক মোড়লের পদধূলিতে এই অভাগা দেশ ধন্য হয়েছিল। কিন্তু তাদের দূতিয়ালি রাজনৈতিক দলগুলোর অচলায়তন ভাঙতে পারেনি। ফলে স্বার্থান্ধ রাজনৈতিক দলগুলোর নিম্ন সাংস্কৃতিক মান, একগুঁয়েমি, নতজানু পরদেশ নির্ভরশীলতার নিয়ামককে নির্বাচন একটি প্রহসন হয়ে দাঁড়ায়। সেই রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন আমরা দফায় দফায় দেখেছি।

আজ ছাত্র-জনতার গণজাগরণ আমাদের সামনে আরেকটি সুযোগ এনে দিয়েছে। রাষ্ট্র ও সমাজ সংস্কারের দ্বারপ্রান্তে আমরা আবার উপনীত হয়েছি। এই সংস্কারের অভিপ্রায় যে সমস্ত বিষয় ধারণ করে তা প্রধানত রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম ও সংস্কৃতি। ধর্ম ও সাংস্কৃতিক চেতনা স্পর্শকাতর এবং হাজার বছর ধরে আমাদের রক্তমজ্জায় লালিত ও বিকশিত। নাতিদীর্ঘ বয়ানে এই বিষয়ের আলোচনা দুরূহ কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আলোচনার সূত্রপাত করা যায়। এই নিবন্ধে শুধু রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকার চেষ্টা করবো। গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা আরোহন। সেই সংসদীয় সাধারণ নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন সংস্কারের রূপরেখা নিম্নে তুলে ধরলাম। বিষয়টি ইতোমধ্যে নাগরিক সমাজে বহুল আলোচিত তবুও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সচেতনতা ও মতামত সৃষ্টির জন্য এই ধরনের ক্রমাগত পঠন প্রাসঙ্গিক হবে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনঃ
ক) মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ৪ বছর। পৃথিবীর অধিকাংশ এমনকি প্রতিবেশী ভারতেরও সংসদের মেয়াদ ৪ বছর। আমাদের ক্ষমতালিপ্সু অধিকাংশ রাজনৈতিক দলেরই ৫ বছর অপেক্ষা করার ধৈর্য এখনও তৈরি হয়নি। পরাজিত হলেই সরকার পতনের আন্দোলন থেকে এটি কিছুটা হলেও বিরত রাখবে।
খ) একটানা ২ মেয়াদের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেনা এবং একই ব্যক্তি সরকার প্রধান ও দলীয় প্রধান হতে পারবে না।
গ) স্পিকার / ডেপুটি স্পিকারের পদের একটি বিরোধী দলকে দিতে হবে।
ঘ) সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাণ স্থায়ী কমিটিগুলির বিশেষ করে অর্থ, অনুমিত হিসাব, পাবলিক একাউন্টস, স্বরাষ্ট্র বিষয়ক কমিটি গুলির সভাপতি মন্ত্রী পদমর্যাদায় বিরোধী দলকে দিতে হবে।
ঙ) কোন দ্বৈত নাগরিক বা সেকেন্ড হোমের বাসিন্দারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। দ্বৈত নাগরিকত্ব দেশপ্রেমের ধারণাকে দুর্বল করে। কেউ নির্বাচন করতে চাইলে তাঁকে বৈদেশিক নাগরিকত্ব সমর্পণ করতে হবে।
চ) ফ্লোর ক্রসিং প্রথা চালু করতে হবে। দলের বিরুদ্ধে কেউ মতামত বা ভোট দিলে তার সদস্যপদ বাতিলের আইন রদ করতে হবে।
ছ) নির্বাচনে পেশাজীবীদের আনুপাতিক অংশগ্রহণ ও দলের ভোটপ্রাপ্তির হারের ওপর সদস্যসংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে।
জ) একদিনে দেশব্যাপী নির্বাচন না করে কয়েক দফায় নির্বাচন করলে আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে।
ঝ) বিরোধী দলীয় সাংসদের অধিকার এবং সুবিধা কোনোভাবেই বৈষম্য করা যাবে না এবং এটা সংবিধানে নিশ্চিত করতে হবে।

জেলা পরিষদঃ
উপজেলা পরিষদের কাছে দায়িত্বভার ন্যস্ত করে এই আলংকারিক পদটি বিলুপ্ত করা যেতে পারে। প্রতি জেলারই একজন দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রী থাকেন। তিনিই জেলার ভালোমন্দ দেখার জন্য যথেষ্ট। জেলা পরিষদ বরং ক্ষমতার দ্ব›দ্ব সৃষ্টি করে এবং প্রশাসনিক ব্যয় বৃদ্ধি করে পক্ষান্তরে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন ঘটায়।

উপজেলা পরিষদঃ
ক) সম্পূর্ণ নির্দলীয়ভাবে এই স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
খ) উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নামক দলীয় কর্মী সন্তুষ্টির এই গুরুত্বহীন পদ দুটি বিলুপ্ত করতে হবে। অর্থের অপচয় আর কোন্দল সৃষ্টি ছাড়া এদের আর কোনো কাজ নেই।
গ) উপজেলা পরিষদের উন্নয়নমূলক বাজেট চেয়ারম্যানের কাছে ন্যস্ত থাকবে। স্থানীয় সংসদ সদস্য উপদেষ্টা হিসাবে থাকবেন।

ইউনিয়ন পরিষদঃ
নির্দলীয়ভাবে এই স্থানীয় পরিষদ নির্বাচন প্রতি ৪ বছর পর পর অনুষ্ঠিত হবে। দলীয় সমর্থক বিবেচনায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে কাউকে বঞ্চিত করা যাবেনা। আইনি প্রক্রিয়া ব্যতীত কাউকে বরখাস্ত করা যাবে না।

সার্বিকভাবে উপরোক্ত নির্বাচনী সংস্কারের জন্য সংবিধান সংশোধন বা নতুন করে সংবিধান প্রণয়নের জন্য জনমত গঠন করতে হবে। দেশব্যাপী সংলাপ আয়োজন করতে হবে এবং সংস্কারের পক্ষে জনগণের রায় নিশ্চিতে গণভোটের আয়োজন করতে হবে। গণভোটের রায় পাওয়া গেলে একটা কন্সটিটিউশনাল এসেম্বলি নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে পাশাপাশি সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলমান থাকবে যাতে কন্সটিটিউশনাল এসেম্বলি দ্রæতই সংবিধান প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং স্বাধীন নির্বাচন কমিশন এবং এর সদস্যগণের নিযুক্তির পদ্ধতি সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত থাকবে।

আমরা আশা করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আলোচ্য দায়িত্বগুলো সুচারুরুপে পালন করবে।

লেখক : বাংলাদেশ সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট