পতন হলো শেখ হাসিনার দেড় দশকের জামানার। আজ সোমবার দুপুরে টানা ১৫ বছর দেশ শাসনের পর পরাজয় হলো আওয়ামী লীগের। অবশ্য, শেখ হাসিনার পতনের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিলো গত মাসের ১৯ তারিখের পর থেকেই। ওইদিন রাতে দেশজুড়ে কারফিউ জারি করে ক্ষমতা প্রলম্বিত করার শেষ চেষ্টাটিও গতকাল বিফলে পরিণত হয়েছে ছাত্র-জনতার প্রবল প্রতিরোধের মুখে। মাত্র কয়েক মিনিটের সিদ্ধান্তে দল ও সরকারের কাউকে না জানিয়ে অনুজ শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে হেলিকপ্টার যোগে দেশত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী। জানা গেছে, ভারত হয়ে শেখ হাসিনা লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয়ের খোঁজে বেরিয়ে যান।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। টানা তিন মেয়াদে বিরোধী মতামত উপেক্ষা করে বেশ দাপটের সঙ্গে দেশ শাসন করলেও শেষ মেয়াদের মাত্র ৭ মাসের মাথায়ই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে মাথা নিচু করে মসনদ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। তাই, এ দিনটি বাঙালি জাতির কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সরকারের পদত্যাগের দাবিতে চলমান অসহযোগ আন্দোলন সফল করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ছিল গতকাল। এর আগে দুইদিনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গড়ে ওঠা এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পুরো জুলাই মাসজুড়েই চলছিল এই আন্দোলন। ছাত্রদের প্রবল চাপের মুখে একপর্যায়ে কোটা সংস্কার করে সরকার। তবে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার জেরে এক দফা দাবি সামনে উঠে আসে। সেই দাবি ছিল- শেখ হাসিনার পদত্যাগ। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার পর থেকে ঢাকার পথে ঢল নামে মানুষের। কারফিউ উপেক্ষা বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকার কেন্দ্রস্থলে আসতে শুরু করেন তারা। এক পর্যায়ে শাহবাগ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে। তারপরেই, মিনিটে মিনিটে পরিবর্তন হতে থাকে সরকারের অবস্থান। যাদের ভরসায় টিকে থাকার চেষ্টা করা হচ্ছিল, তারাও মুখ ফিরিয়ে নেন। জানা যায়, দুপুর সোয়া ১টা নাগাদ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। তার আগেই সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের সিদ্ধান্তের বিষয়টি অবহিত করেন।
পরে, গণভবন থেকে শেখ হাসিনা বেরিয়ে যাওয়ার পর দেশের বর্তমান সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলের নেতাসহ বিশিষ্টজনদের সঙ্গে সেনা সদর দপ্তরে আলোচনায় বসেন সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। এরপর বিকেল পৌনে ৪টায় জাতির উদ্দেশে সেনাপ্রধান ব্রিফিং করেন।
বক্তব্যে তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হচ্ছে বলে সাংবাদিকদের জানান। সেনাবাহিনীর প্রধান বলেন, ‘রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল চলছে। একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে। সেনাবাহিনীর ওপর আস্থা রাখুন। আমরা রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি।’
সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের ব্রিফিংয়ের আগেই শেখ হাসিনার গদত্যাগের বিষয়টি চাউর হয়ে গেলে বাঁধভাঙা আনন্দে নারী-পুরুষ, শ্রমিক-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। হাজার হাজার জনতা উল্লাস প্রকাশ করতে থাকে। শেখ হাসিনার গোপনে চলে যাওয়ার খবরে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত আন্দোলনকারী ছাত্রজনতা। এসময় তাদের স্লোগান শোনা যায়, ‘স্বৈরাচারের পতন হয়েছে’; ‘পলাইছে রে পলাইছে, শেখ হাসিনা পলাইছে’; ‘স্বৈরাচার পালিয়েছে’।
বলা বাহূল্য, ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট প্রায় তিন-চতুর্থাংশ আসনে জয়লাভ করে। বিজয়ী দলের সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে তিনি ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তার দল আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে ২৬০টি আসন লাভ করে। তারপরের ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। ফলে, আবারও অনায়াসে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা। পরবর্তিতে, ২০১৮ সালের নির্বাচন বাংলাদেশে ‘রাতের ভোট’ নামে এমন এক ভোট হয়েছিল, যে ভোটে বিএনপি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও আসন পেয়েছিল মাত্র ৭টি।। কারণ, সেবার অভিযোগ উঠেছিল, অসংখ্য বুথে নির্বাচনের আগের রাতেই ভোটবাক্স ভরে রাখা হয়েছিল অবৈধ ব্যালটে। সেই একাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৫৭ আসনে জিতেছিল শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ। কিন্ত মাত্র সাত মাস আগে সম্পন্ন হওয়া সংসদের দ্বাদশ নির্বাচন বেশিরভাগ দল বর্জন করে। তদাপিও, নিজেরা-নিজেরা ভোটের আয়োজন করে ২২৪ আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। ৬৩ আসনে জয়ী হয় জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের নির্দলীয় প্রার্থীরা। ব্রুট মেজোরেটির দল হয়েও অত্যন্ত করুণভাবে গতকাল শাসন ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হলো আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে।