বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বই বেশ কিছুদিন ধরে কোভিডের প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছে। বলতে গেলে আমরা সবাই কোভিডের সাথে সহাবস্থানকেই আমাদের ভবিষ্যতব্য বলে মেনে নিয়েছি। এটা ঠিক যে আমাদের কোভিডের সাথে বসবাসে অভ্যস্ত হতে হবে। তবে সহাবস্থান করতে হবে কোভিডের অস্তিত্ব আর তার বাস্তবতাকে স্বীকার করে আর সম্ভাব্য সব সাবধানতা অবলম্বন করেই। আমরা যদি ধরে নেই আমাদের চারপাশে কোভিড বলে কিছু নেই এবং আমাদের সতর্কতার কোন প্রয়োজন নেই তবে তা হবে কোভিড নামের কুমিরের জন্য নতুন করে খাল কাটা।
বৈশ্বিক পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে কোভিড এখনো বহাল তবিয়তেই আমাদের চারপাশে আছে। এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকার সর্বত্রই হাজার হাজার সংক্রমণ আর অজ¯্র মৃত্যুর কারণ হয়ে সে এখনো তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সম্প্রতি টেস্ট করানোর সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। যেহেতু মৃত্যুহার কম, সংক্রমণের তীব্রতাও কিছুটা কমে এসেছে তাই মানুষ আগের মতো টেস্ট করাচ্ছেন না। কিন্তু তারপরও প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত কয়েক সপ্তাহে যে কয়জন টেস্ট করিয়েছেন তার প্রায় ৭ শতাংশ পজিটিভ হয়েছেন। সংখ্যাটি তুচ্ছ নয়। আসল সংখ্যা হবে তার বহুগুণ বেশি। কারণ, আমাদের দেশে টেস্ট করানোর প্রতি বিদ্যমান অনীহা। এখানে আরো কিছু বিষয় প্রণিধানযোগ্য। যেহেতু মৃদু ও মধ্য-তীব্রতার কোভিডের কোন সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই তাই অনেকেই ভাবেন টেস্ট করিয়ে পজিটিভ হলেই বা কি! মাঝখানে নিজেকে আইসোলেটেড রাখতে হবে। টেস্ট না করালে সে বাধ্যবাধকতা নেই। আমাদের টেস্ট করানোর সংখ্যা কম হওয়ার এটিও একটি কারণ। ইতিমধ্যে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে বিপুল সংখ্যক মানুষ ভ্যাক্সিন গ্রহণ করেছেন। ফলে তাদের অনেকের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিরোধ ক্ষমতা আবার অন্য অনেকের মধ্যে আংশিক প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মেছে। তাদের মধ্যে কোভিড সংক্রমিত হলেও অনেকেই থাকছেন উপসর্গবিহীন, আবার কারো কারো হচ্ছে মৃদু উপসর্গ। তারা নিজেদের অজান্তেই কোভিড বহন করেছেন এবং ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তাদের চারপাশে যারা সুস্থ কিংবা ভ্যাক্সিনপ্রাপ্ত তাদের হয়তো তাতে কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হচ্ছে না। কিন্তু যারা বৃদ্ধ, দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত এবং ভ্যাক্সিনপ্রাপ্ত নন তাদের জন্য তা এখনো সাক্ষাত মৃত্যুর সমন। ভ্যাক্সিন যেমন কোভিডের মোকাবেলায় একটি কার্যকর অস্ত্র, ঠিক তেমনভাবে ভ্যাক্সিনজনিত আংশিক প্রতিরোধ ক্ষমতা আমাদের উদাসীনতা ও অসতর্কতার প্রেক্ষাপটে এক নতুন চ্যালেঞ্জের জন্ম দিয়েছে। কারণ, আংশিক প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্নরা অসচেতনভাবে কোভিড সংক্রমণ ছড়িয়ে দিচ্ছেন। চলমান কোভিড মোকাবেলায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের এই বিষয়টিও আমলে নিতে হচ্ছে।
সম্প্রতি ঈদের ছুটিতে সারা দেশে ব্যাপক জনচলাচল ও যাতায়াত বিনিময় হয়েছে যা কোভিড সংক্রমণের মোক্ষম সুযোগ করে দিয়েছে। বিশেষ করে বৃদ্ধ, দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী এবং যারা ভ্যাক্সিন গ্রহণ করেননি তারা নতুন করে কোভিডের ঝুঁকিতে পড়েছেন। তারা যদি জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গে আক্রান্ত হন তাহলে তাদের অবশ্যই কোভিড টেস্ট করানো প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে যে ভ্যাক্সিন ও ভাইরাসের নানামুখী চারিত্রিক বিবর্তনের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই কোভিডকে আদি রূপে দেখা যাচ্ছে না। ফলে অনেকের মধ্যেই পরিচিত সব লক্ষণ প্রকাশিত হচ্ছে না। কোন কোন ক্ষেত্রে কেবলমাত্র গায়ে ব্যথা, ক্লান্তি বা জ্বর এর যে কোন একটি লক্ষণের মাধ্যমেই কোভিড তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। উপসর্গ যত সামান্যই হোক না কেন, আপনার পরিবারের ও চারপাশের দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষটির কথা ভেবেই আপনাকে টেস্ট করাতে হবে এবং প্রয়োজনে আইসোলেটেড থাকতে হবে।
এই বর্ষায় আবার মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে নেমে এসেছে ডেঙ্গুর খড়গ। আষাঢ়ের শুরু থেকেই দেশের বিভিন্নস্থানে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বৃষ্টির জমে থাকা পানি দিচ্ছে মশার বংশবৃদ্ধির ব্যাপক সুযোগ। সে কারণে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। আমাদের চারপাশে একই সাথে ডেঙ্গু আর কোভিড বিরাজমান থাকলে তা মারাত্মক জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ ঘটাতে পারে। নানা ভিন্নতা থাকলেও এই দুই রোগের লক্ষণ ও উপসর্গের বেশ কিছু মিলও রয়েছে। এই দুই রোগেই জ্বর, মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা, ক্লান্তি- এ ধরনের উপসর্গ দেখা যায়। তাই উপযুক্ত পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমেই কেবল সঠিক চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে অনুমান নির্ভর চিকিৎসা দেয়ার কোন সুযোগ নেই, বরং তা রোগীর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। আমরা জানি যে ডেঙ্গুতে রক্তের অনুচক্রিকা (প্ল্যাটিলেট) নামক রক্তকণিকার সংখ্যা কমে যায়। অনুচক্রিকা রক্তকে জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। তার সংখ্যা যখন অনেক কমে যায় তখন তা রোগীর শরীরে অভ্যন্তরীণ রক্তপাত ঘটিয়ে তার মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।
অন্যদিকে, কোভিডে অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর রক্ত জমাট বাঁধতে থাকে, তখন তাকে রক্ত তরল রাখার ওষুধ দিতে হয়। এ পর্যায়ে ডেঙ্গু আর কোভিডের চিকিৎসা ভিন্নমুখী। আবার তীব্র কোভিডে অনেক সময় অনুচক্রিকার সংখ্যা কমতে থাকে, তখন তার চিকিৎসায় রক্ত তরল করার ওষুধ উলটো ফল দেয়। বিষয়টি অত্যন্ত জটিল এবং প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ ছাড়া রোগীকে চিকিৎসা দেয়া দুঃসাধ্য। কিন্তু তার আগে আমাদের নিশ্চিত হতে হবে রোগী কি ডেঙ্গুতে ভুগছেন, নাকি কোভিডে। অনুমানভিত্তিক চিকিৎসায় হিতে বিপরীত হতে পারে। তবে জটিলতার এখানেই শেষ নয়। ক্ষেত্র বিশেষে একই রোগীর মধ্যে একই সাথে কোভিড আর ডেঙ্গুর সংক্রমণ হয়ে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করছে। এই পরিস্থিতি সামলাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও হিমশিম খাচ্ছেন। রক্তকণিকার উপর এই দুই রোগের কখনো বিপরীত ধর্মী আবার কখনো সমধর্মী প্রভাব এই রোগের চিকিৎসাকে সমূহ চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়ে রোগীর জীবনকে বিপন্ন করে তুলতে পারে।
দেখা যাচ্ছে আমাদের চারপাশে কোভিড এবং ডেঙ্গু একসাথে বিরাজমান থাকলে যেটুকু চ্যালেঞ্জ, একই রোগীর মধ্যে এই দুই রোগ একই সময়ে অবস্থান করে সে চ্যালেঞ্জ বেড়ে যায় বহুগুণে। আমাদের বর্ষার সময়টি যেন এই দুই রোগের মধুচন্দ্রিমার সময়। এই সময়টুকুতে আমাদের বাড়তি সতর্কতার প্রয়োজন। সন্দেহজনক কোন লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দেয়া মাত্রই কোভিড এবং ডেঙ্গু দুটোরই টেস্ট করাতে হবে। একটি পজিটিভ হলে অন্যটি নেই এমনটি ভাবার সুযোগ নেই। আমাদের উদাসীনতা শুধু নিজের নয় চারপাশের অন্যদের জীবনকেও মারাত্মক ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিতে পারে।
সর্বোচ্চ সতর্কতা, সচেতনতা ও সময়মতো টেস্ট করিয়ে যথাযথ চিকিৎসা নিয়ে ডেঙ্গু আর কোভিডের মধুচন্দ্রিমায় শয্যায় আমাদের কাঁটা বিছাতে হবে।
লেখকঃ অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান, এডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস ও সমাজকর্মী।