চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪

নারীর ক্ষমতায়ন হলো, দৃষ্টিভঙ্গি কি বদলালো!

অনলাইন ডেস্ক

৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ | ৯:৩৫ অপরাহ্ণ

পত্রিকার পাতা খুললে মাঝেমধ্যে এমন সব খবরে চোখ পড়ে, যা রীতিমতো ভয়াবহ; নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক। নানা ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি সত্ত্বেও নারীর প্রতি মনোভাব এখনও পিছিয়ে পড়া সমাজের কথাই মনে করিয়ে দেয়। নারীকে সহজে হেনস্তা করা যায় এবং পার পাওয়া যায়- এমন ধারণা অপরাধীদের মধ্যে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনে ভূমিকা রাখে।

সবশেষ একটি ঘটনা জানা গেল সংবাদমাধ্যম সূত্রে। ঘটনাস্থল ঢাকার শ্যামলী। এখান থেকেই একটি মেয়েকে পুলিশ পরিচয়ে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেয়েটিকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে মালপত্র কেড়ে নেওয়া ছাড়াও শারীরিকভাবে হেনস্তা করা হয়। বড় কোনো দুর্ঘটনার আগেই মেয়েটি রক্ষা পেয়েছে। পুলিশ অভিযোগ আমলে নিয়ে অভিযুক্তকে আটক করেছে। এর পরই বেরিয়ে এসেছে এই অপরাধীর আরও এমন অপরাধের তথ্য। জানা গেছে, তার শিকারের প্রধান লক্ষ্য ছিল নারী। অর্থাৎ নারীদের সহজ শিকারে পরিণত করা যায়। কিন্তু এখানে যেটি সবচেয়ে লক্ষণীয়, দিনদুপুরে রাজধানী ঢাকার মতো জায়গায় এমন ঘটনা ঘটে গেল! নারী যে কতটা অরক্ষিত, তা এই ঘটনা থেকে কিছুটা অনুমান করা যায়।

পৃথিবীতে বসতি শুরু হয়েছিল নারী-পুরুষের যৌথ প্রচেষ্টায়। সভ্যতার শুরুতেই নারী-পুরুষের লিঙ্গভিত্তিক তফাত তৈরি হয়নি। মানুষ হিসেবে বিকশিত হওয়ার শ্রেয় বোধটি ছিল প্রধান। কিন্তু সময় এক রকম থাকেনি। গড়িয়েছে প্রবল ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। নারী ছিটকে পড়েছে মানুষ নামের বিশেষণ থেকে। শুরু হয়েছে পুরুষের একতরফা কর্তৃত্ব। তারা এ কর্তৃত্ব গড়ে তোলে দুটো ভিত্তির ওপর। ধর্ম আর অর্থনীতি। এ দুটো ক্ষেত্র নারীকে প্রবলভাবে কোণঠাসা করে রেখেছে। এ দুটো এ সংস্কৃতির মধ্যে নারী সংক্রান্ত ভাবনার মৌল সত্য। এর পাশাপাশি নানা ধরনের ভিন্নমুখী তরঙ্গ এসে আঘাত করতে শুরু করেছে।

গণিতবিদ পিথাগোরাস একটি ভ্রাতৃসংঘ গঠন করেছিলেন। এ সংঘের প্রধান কাজ ছিল গাণিতিক চিন্তাধারার তত্ত্বঘটিত অভিমত তৈরি করা। তাঁরাই প্রথম আবিস্কার করেন, পৃথিবী চ্যাপ্টা নয়, গোলাকার। কোনো নারী এই ভ্রাতৃসংঘের সদস্য ছিল না। ড. কাজী মোতাহার হোসেন গণিতশাস্ত্রের ইতিহাস বইতে উল্লেখ করেছেন, পিথাগোরিয়ানরা জোড়-বিজোড় সংখ্যার নামকরণ করেছিলেন। তাঁরা জোড় সংখ্যাটি স্ত্রী আর বিজোড় সংখ্যাকে পুরুষ বলে মনে করতেন। তাঁদের ভ্রাতৃসংঘের সদস্য সবাই পুরুষ ছিল। এজন্য স্বভাবতই বিজোড় সংখ্যাকে স্বর্গীয় আর জোড় সংখ্যাকে পার্থিব বলে বিবেচনা করা হতো। তাদের জোড় সংখ্যা বা নারী জাতি এ জন্য কোনো প্রতিবাদ করেনি। অন্তত বিজোড় সংখ্যা যে পয়মন্ত- তা স্বীকার করতে ওই যুগের নারী সমাজের দ্বিধা ছিল না।

বাংলার সংস্কৃতিতে জোড় সংখ্যা নারী বলে উল্লেখ পাওয়া যায় খনার বচনে। যেমন- ‘বাণের পৃষ্ঠে বাণ/পেটের ছেলে গনে আন/নামে মাসে করে এক/সাতে হরে সন্তান দেখ/এক তিন তাকে বাণ/তবে নারী পুত্রবান/দুই চারি ছয়/অবশ্য তার কন্যা হয়/থাকিলে তার শূন্য সাত/হবে নারীর গর্ভপাত।’ এই বচনে দেখা যাচ্ছে জোড় সংখ্যা নারী। কিন্তু বিজোড় সংখ্যা পুরুষ দেখানো হলেও তা পয়মন্ত নয়। বলা হয়েছে, ‘থাকিলে তার শূন্য সাত হবে নারীর গর্ভপাত। খনা জ্যোতিষীর দৃষ্টিকোণ থেকে জোড়-বিজোড় সংখ্যার ভালোমন্দ বিচার করেছেন। কিন্তু পিথাগোরিয়ানরা ধারণা থেকে নিজেদের স্বর্গের প্রতিনিধি বানিয়েছেন এবং এককভাবে স্বর্গীয় সুখলাভের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন। গণিতের মতো জটিল শাস্ত্র যাঁরা চর্চা করেছিলেন, তাঁরা দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করেছিলেন যে, পৃথিবী নারীর। নারীরা এটা সানন্দে স্বীকার করেছিল। এ জন্য পিথাগোরিয়ানদের সময়ের নারীরা জোড় সংখ্যায় কোনো আপত্তি করেনি। আপত্তি করার যে কথা নয় সে সময়কে নিয়ে যাঁরা বিশ্নেষণ করেছিলেন, তাঁরা নারীর মনোভাব বুঝতে চাননি। নারীদের বোঝার মতো পরিসর পুরুষতান্ত্রিক সমাজ রাখেনি।

দেখা গেছে, কখনও কোনো নারী রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পুরুষতন্ত্রের কাছে বন্দি হন। তার প্রমাণ ভারতের ইন্দিরা গান্ধী। তাঁর সময়ে ১৯৭৪ সালে ভারত পরমাণু শক্তির বিকাশ ঘটায়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় পরমাণু শক্তি হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ভারত। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো প্রসঙ্গে ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায় লেখেন, পারমাণবিক বোমা নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। এ প্রবন্ধে শান্তির পক্ষে, মানুষের পক্ষে তাঁর আবেদন ছিল সংবেদনশীল। এ ক্ষেত্রে নারীর মেধা ও মননের সমন্বয় পুরুষতন্ত্রের কাছে নতি স্বীকার করেনি। অধিকার মানুষের বেঁচে থাকার নূ্যনতম চাহিদার স্বীকৃতি। যদি তাই হয়, তবে শুধু নারীর অধিকার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে কেন? যেখানে বঞ্চনা, সেখানেই অধিকারের প্রশ্ন। আর নারীর বঞ্চনার শিকড়টি অনেক গভীরে প্রোথিত। কেননা, এই সংস্কৃতির একটি লক্ষণীয় দিক হলো, নারীকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা না করে তাকে নারী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা। ফলে মৌল সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখার কারণে এই সংস্কৃতিতে নারীর প্রতি বিবেচনা অনেক ক্ষেত্রেই নেতিবাচক।

আমাদের দেশে একটি প্রচলিত প্রবাদ- ‘ভাগ্যবানের বউ মরে আর অভাগার গরু মরে।’ কোনো কোনো পুরুষ এই প্রবাদে উৎফুল্ল হয়। ভুলে যায়, কত কুৎসিত এর অন্তর্নিহিত অর্থ। এই প্রবাদে নারী গরুর চেয়েও কম মূল্যবান। কেননা, অভাগার স্ত্রী মরলে কিছু যায় আসে না, কিন্তু গরু মরলেই সে সর্বস্বান্ত হয়। এখানেই নারী-পুরুষের সম্পর্কের প্রশ্ন। সম্পর্ক যেখানে শরীরের তখন সেটা এমনই কদর্য। একই কারণে সুস্থ মননশীল মস্তিস্ক বলে, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। এর দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তি- সেই সঙ্গে মনমতো পতি যদি মেলে। দেখা যায়, প্রথম পঙ্‌ক্তি প্রায়ই উচ্চারিত হয় দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তি বাদ দিয়ে। এটাও সংস্কৃতিতে নারী-পুরুষ সম্পর্কের নেতিবাচক ভাবনার বহিঃপ্রকাশ, যেখানে অনায়াসে নারীকে দাবিয়ে রাখার এক ধরনের মানসিক কৌশল। নারীকে সংসারের চার দেয়ালের ভেতর বন্দি করে রাখার এমন নানা উপায় পুরুষ নিরন্তর খুঁজে ফিরছে।

তবে এখনকার বাংলাদেশের দিকে যখন তাকাই, দেখি রাষ্ট্রক্ষমতায় একজন নারী, তখন নারীর প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পাওয়াটা কষ্টের। বাংলাদেশে নারী-পুরুষের সমতার কথা মুখে মুখে না বলে তা সমাজে প্রতিফলিত হবে- এটাই কাম্য। তথ্যসূত্র: সমকাল

লেখক: সেলিনা হোসেন, কথাসাহিত্যিক, বাংলা একাডেমির সভাপতি

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট