চট্টগ্রাম রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

চলচ্চিত্র প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গ : আলফা

মানিক মানবিক

৭ ডিসেম্বর, ২০১৯ | ৪:৫৭ পূর্বাহ্ণ

নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর চলচ্চিত্র মানেই অন্যকিছু এবং বড়কিছু। বিশেষ করে তাঁর ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্র দেখতে গিয়ে আমি একদম মুগ্ধ এবং বাকরহিত হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়ে আমি আমার ব্যক্তিগত আবেগ চেপে রাখতে পারিনি; আমি তাঁর পা ছুঁয়েছিলাম আর আমার চোখে ছিল অশ্রু। কেননা ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রের গল্পের সাথে ৭১’র মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পরিবারের অন্যতম মুক্তিযোদ্ধা সেজ মামা অধীর’র হারিয়ে যাওয়ার ভীষণ মিল খুঁজে পেয়েছিলাম। সে আবেগঘন মুহূর্তে বাচ্চুভাই সস্নেহে আমার মাথায় হাত রেখে সান্ত¡না দিয়েছিলেন।

দীর্ঘ আট বছর পর আবার তাঁর চলচ্চিত্র ‘আলফা’। প্রচ- কৌতূহল এবং উত্তেজনা নিয়ে আমি সিনেমা দেখতে গেলাম।
এবং ‘আলফা’ দেখতে গিয়ে আমি আবার আবেগতাড়িত হলাম।
এ তো গল্প নয়; এ যেন আমার জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। ঝিলের জলে ভেসে আছে নাম পরিচয়হীন এক যুবকের লাশ এবং ঐ লাশটি যেন আমারই লাশ। ঝিলের জলে ভাসতে ভাসতে আমি যেন আমারই অস্তিত্বের ঘোষণা দিচ্ছি। চিৎকারে চিৎকারে জানান দিচ্ছি; একদিন আমিও বেঁচে ছিলাম, আমারও ঘরসংসার ছিল, ছিলো বাবা-মায়ের স্নেহ, ভাই-বোনের ভালোবাসা। কিন্তু এই নগরসভ্যতা আমাকে ঠাঁই দিলো না, বাঁচাতে দিলো না, আমাকে বানালো নাম-গোত্রহীন বেওয়ারিশ।
ঝিলের জলে ভেসে থাকা একটি বেওয়ারিশ লাশ নিয়ে গল্প এগোতে থাকে; অথবা গল্পকে কেন্দ্র করে একটি লাশ ঘুরতে থাকে। তার সাথে যুক্ত হয় নিত্যকার জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত এবং অনিত্য দিনের দ্বন্দ্ব-বিরোধ। ‘আলফা’ শুধু চলচ্চিত্র নয়, চলচ্চিত্রের চেয়েও বেশি কিছু। ‘আলফা’ কখনো কবিতা, কখনো গদ্য, কখনো চিত্রকলা, কখনো জীবন, কখনো রাজনৈতিক বাস্তবতা।

চেনা বাস্তবতার অচেনা গলি; গলি ছাপিয়ে রাজপথ; রাজপথ থেকে রাজনীতি; রাষ্ট্র-প্রশাসন; সবকিছুই আলফা’র ঘটনা প্রবাহে আসে-যায়, যায়-আসে, আবার কখনো জগদ্দল হয়ে চেপে থাকে মনে-মননে।
দর্শক হয়েও আমি দর্শক নই, ভিক্টিম হয়েও আমি ভিক্টিম নই। ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত আমাকে রক্তাক্ত করে বারবার বারংবার।
নগরসভ্যতার তথাকথিত অসভ্যতা ঘুরেফিরে আসে গল্পের জানালায়-দরজায়-বারান্দায়; না কোন স্বীকৃতির প্রত্যাশা নেই, আছে অস্তিত্বের অমোঘ ঘোষণা। আমি মুক্তি চাই অথবা মুক্ত করতে চাই; ছিন্ন করতে চাই অশুভ চক্র। কিন্তু নাগরিক জীবনের নিরুপদ্রব প্রলোভন আমাকে সরিয়ে রাখে নিরাপদ দূরত্বে। পলায়নপর আমি এবং দ্রোহ-বিদ্রোহের আমি পরস্পর দাঁড়িয়ে থাকি মুখ ও মুখোশে। ‘আলফা’ তখন সার্থকভাবে হয়ে ওঠে আমার এবং আমাদের গল্প।
লোক সংস্কৃতি ও বাঙালি সংস্কৃতি আমাদের জীবনের চরমতম সত্য। আমরা চাই বা না চাই, প্রচলিত এই সংস্কৃতি টিকে আছে আমাদের শরীরে, মনে, প্রতিটি শিরা-উপশিরায়। শিবের গাজন, মহরমের মাতম, লাঠিখেলা, বোরাক, হরগৌরী, আদিবাসীদের বিবিধ লোকাচার ‘আলফা’ চলচ্চিত্রে মূর্ত হয়ে ওঠে বিবিধ ঘটনা প্রবাহে।
আলফা’ চলচ্চিত্রে একটি অদ্ভুত গাধার দেখা মেলে। যে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘আর্টিস্ট’ এর বাহন হিসেবে ঘুরে বেড়ায় রাজধানীর পথে পথে। প্রতীকী এই গাধার হেঁটে যাওয়া আমাদের মনে করিয়ে যেন অদ্ভুত গাধার পিঠে সওয়ার হয়ে চলছে এই নগরসভ্যতা।

আলফা’র চিত্রায়নে তথাকথিত ফটোগ্রাফিক গ্ল্যামার নেই, আছে বাস্তবানুগ প্রতিচ্ছবি। চাইলেই নিঃসন্দেহে চমৎকার চমৎকার ফ্রেম তৈরি করে চমক সৃষ্টি করা যেত। কিন্তু পরিচালক হয়তো সে পথে হাঁটতে চাননি। কেননা আমরা জানি রূঢ় বাস্তবতা সবসময়ই গ্ল্যামারহীন।
অভিনয়ে সবাই মোটামুটি সাবলীল। তবে একমাত্র এটিএম শামসুজ্জামান থাকার কারণেই দর্শক বুঝতে পারে এটি একটি চলচ্চিত্র। না হলে ডকুমেন্টারি ভেবে ভুল হবার সম্ভাবনা খুবই বেশি।

এই চলচ্চিত্রে লোকসঙ্গীতের ব্যবহার বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। আমরা লক্ষ্য করি গল্পের বিভিন্ন বাঁকে, পালাগান বা লোকগান ফিরে ফিরে আসে মানবতার জয়গাথা নিয়ে। তবে এই চলচ্চিত্রে তৃতীয় লিঙ্গের সরব উপস্থিতি থাকলেও তাদের নিজস্ব রিচুয়ালের অনুপস্থিতি সামান্য হলেও চোখে পড়ে আমাদের।
চলচ্চিত্র হিসেবে ‘আলফা’ হয়তো দেশীয় চলচ্চিত্রের ধারায় একটি নতুন বৃক্ষ রোপণ করলো। এই চলচ্চিত্র নতুন নির্মাতাদের ভিন্ন ভাবনার খোরাক জোগাবে সন্দেহ নেই। সে ভাবনার ধারাবাহিকতায় আমাদের চলচ্চিত্র আরো ঋদ্ধ হবে, নির্মিত হবে নতুন ধরনের গল্প। মুক্তিযোদ্ধা, মঞ্চের কবি, সার্থক চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ভাইয়ের কাছ থেকে আমরা এমনই একটি সৃষ্টির প্রত্যাশায় ছিলাম; তিনি আমাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ করেছেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট