চট্টগ্রাম রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

মঞ্চমুকুট নাট্য সম্প্রদায়ের পুতুল খেলা

শাহীন চৌধুরী

৩০ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:৪৭ পূর্বাহ্ণ

ভোরের আলোটা ঠিক জানালার কাছে এসে চোখ রাঙায়। কোলাহল-লোকালয় সব প্রাত্যহিক জীবনের বহমান চিত্র। এর ভিতরের যে জীবনের গল্প সেটি ঠিক ছুঁেয় যায় আমাদের সংস্কৃতি আমাদের নাটককে। মানুষের জীবনটা তাই সংস্কৃতির আবর্তে বেঁেচ থাকে। আমরা ওখান থেকে আমাদের জীবনের মুহূর্তগুলো খুঁজে নেই। আর এ শিক্ষা চেতনা আর ভাবনায় টোকা দেয়। এই অর্থে আমাদের জীবনের ধারা, পাওয়া-না পাওয়া, কষ্ট, আনন্দ-বেদনা, সবকিছু বেঁচে রাখে যে স্বপ্ন দোয়ারে, তাহল আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের মঞ্চ।

আলোকিত ধারায় মঞ্চের আলো ছায়ায় চট্টগ্রাম গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের প্রাণবন্ত যে দলটি নিয়মিত নাট্যচর্চার নিরিকে বাধার অচলায়তন ভেঙে কেবল মঞ্চেই প্রাণপণ নাটকের প্রবহমান স্রােতে এগিয়ে যাচ্ছে- সে দলটি মঞ্চমুকুট নাট্য সম্প্রদায়।

সম্প্রতি মঞ্চমুকুটের ১৫তম প্রযোজনা নরওয়ের বিখ্যাত নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের ‘এ ডলস্ হাউস’ অবলম্বনে ‘পুতুল খেলা’ নাটকটি থিয়েটার ইনস্টিটিউট মঞ্চে দেখার সুযোগ হয়। ইবসেন আধুনিক নাটকের জনক হিসেবে পরিচিত। যিনি ছিলেন প্রথা বিরোধী একজন নাট্যকার। কেননা তাঁর যুগে নাটককে রুচিশীল কর্ম হিসেবে ভাবা হত না। তিনি এ প্রথাগত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে গিয়ে মানব চরিত্রকে নাটকে তুলে এনেছেন। পুরুষশাসিত সমাজে নিষ্পেষিত নারীদের তীব্র সংগ্রাম নারী অধিকার ও নারী ব্যক্তিত্বের উন্মেষ তাঁর নাটকের উপজীব্য বিষয়। ১৮৭৫ সালে ইবসেন মিউনিখে চলে যান সেখানেই ১৮৭৯ তে ‘এ ডলস্ হাউস’রচনা করেন। যা শম্ভুমিত্র ‘পুতুল খেলা’ নামে নাটকটির রূপান্তরকরেন। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর অবস্থান কোথায়? সমাজে এক নারী রমা, স্ত্রী, বোনের ভূমিকা ছাড়া আর কিছু আছে কি? সমাজে নারীর বিশ্বাস বা ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই। পুরুষের আবর্তে থাকে নারী সেটি বাবা হোক বা স্বামী। কোনো এক শৃঙ্খলিত নিয়মের সুতোয় বাঁধা থাকে নারী। আধুনিকতার নামে নারী পুতুলে পরিণত হয়। পুতুল যেমন নিজে কিছু করতে পারে না অন্যের দ্বারা পরিচালিত হয়। নারী তার ভাবাবেগের কোন মূল্য আশা করতে পারে না তার পরিবার থেকে। যে টুকু সে ঢেলে দিতে চায় পরিবারের জন্য সময় কিংবা পরিস্থিতির সংকটে তার দায় কেউ গ্রহণ করে না। নারী যে একজন মানুষ সে সত্যটা স্পস্ট করতে তাকে আশ্রয় নিতে হয় প্রতিবাদ-প্রখরতার।

এ নাটকে বুলু চরিত্র সে যখনই আবিষ্কার করে তার কষ্ট তার অবস্থান তখন সে নিজেকে একক চরিত্রে দাঁড় করায়। তখনই হয়তার মুক্তি। তখন তাকে অনেক কিছু ছেড়ে আসতে হয়। তবুও সে নিজেকে আপন আলোয় প্রকাশ করে স্বস্তি পায়। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে এ সংকটটা বর্তমান। একটি পরিবারে সুখের অন্ত নেই-সব যেন সরল অংকে চলে। কিন্তু আত্মসম্মান বোধের প্রশ্নে শুরু হয় দ্বন্ধ আর তাতে নারী লড়াই করে নিজেকে মুক্তির পথে এগিয়ে নেয়- কিন্তু তাকে হারাতে হয় অতীত বর্তমান-ভবিষ্যৎ। এমন পথহীন পথের যাত্রায় নারী এক জটিল চরিত্র। মঞ্চমুকুটের এই প্রযোজনাটি চট্টগ্রামের নাট্য চর্চারই দায়বদ্ধতা বলা যায়। চট্টগ্রামে বরাবরই সিরিয়াস নাটকগুলো প্রথম সারিতে থাকে। দলগুলোর অবস্থান সুদৃঢ় করতে এই অভিনয় নির্ভর নাটকগুলো বড় বেশি প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে মঞ্চমুকুট নাট্য সম্প্রদায় সমপোযোগী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং তারা নিয়মিত নাট্য চর্চার নিরিখে একেবারে আপোষহীনতার পরিচয় দিচ্ছে। এমনিতে অর্থ, হল নিয়মিত পাওয়া নানাজটিলতা আছে কিন্তু দলটি নাটক মঞ্চায়নে কোনভাবেই পিছিয়ে নেই।

অভিনয়ে অতি অভিনয় গ্রহণীয় নয়। বুলু চরিত্রে কংকন দাশ, আর তপনের চরিত্রে সুচরিত খোকন আর সীমা চৌধুরীর অভিনয় সাবলীল। তবে পোশাক নির্বাচনে নির্দেশককে আর একটু হতে হবে। আবহ কখনো কখনো সংলাপকেও ছাপিয়ে গেছে। নাটকটির আলো, পোশাক ও নির্দেশনায় রয়েছেন-সুচরিত খোকন আলো প্রক্ষেপনে-মহাশ্বেতা দাশগুপ্ত, আবহে-বিরাজ সরকার/ ওয়াহিদা পারভিন দৃষ্টি। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন-অলিউর রহমান, সীমা চৌধুরী, শহীদুলইসলাম, বাহাউদ্দিন মিরন, কংকন দাশ, সুচরিত খোকন। নাটক হোক চলমান সমাজের আয়না। মঞ্চমুকুটনাট্য সম্প্রদায় সে অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাক সে প্রত্যাশা রইল।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট