চট্টগ্রাম শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪

ছোটদের সুকুমার রায় দুলাল

শর্মা চৌধুরী

২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৫৬ পূর্বাহ্ণ

শিশুসাহিত্যিক ও ছড়াকার সুকুমার রায় বাংলা শিশুসাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। সুকুমার রায়ের লেখা কবিতার বই আবোল-তাবোল, গল্প হযবরল, গল্প সংকলন পাগলী দাশু এবং নাটক চলচ্চিত্র চঞ্চরীকে বিশ্ব সাহিত্যে সর্বযুগের সেরা শিশুসাহিত্যের অন্যতম বলে মনে করা হয়। সুকুমার রায়ের মৃত্যুর বহুবছর পরেও তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম শিশুসাহিত্যিকদের একজন।

সুকামার রায়ের জন্ম ১৮৮৭ সালের ৩০ অক্টোবর কলকাতার এক ঐতিহ্যবাহী ব্রাহ্ম পরিবারে। তার পিতা উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল রত্ন। মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের নেতা দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কন্যা। সুবিনয় ও সুবিমল তার দুই ভাই। এছাড়াও তিন বোন ছিল সুকুমারের।
সুকুমার রায় জন্মেছিলেন বাংলার নবজাগরণের স্বর্ণযুগে। তার পারিবারিক পরিবেশ ছিল সাহিত্য অনুরাগী। যা তার সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হয়। উপেন্দ্র কিশোর ছিলেন শিশুতোষ গল্প ও জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার ও শৌখিন জ্যোতির্বিদ। উপেন্দ্র কিশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যার প্রভাব সুকুমারের উপর পড়েছিল। এছাড়াও রায় পরিবারের সঙ্গে বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রমুখের সম্পর্ক ছিল। উপেন্দ্র কিশোর ছাপার ব্লক তৈরির কৌশল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান এবং মানসম্পন্ন ব্লক তৈরির একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মেসার্স ইউ রয় অ্যান্ড সন্স নামের ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সুকুমার যুক্ত ছিলেন।
কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯০৬ সালে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় অনার্সসহ বিএসসি করার পর সুকুমার রায় মুদ্রণ বিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য ১৯১১ সালে বিলেত যান।

সেখানে তিনি আলোকচিত্র ও মুদ্রণ প্রযুক্তির ওপর পড়াশোনা করেন এবং কালক্রমে ভারতের প্রথম সারির আলোকচিত্রী ও লিথোগ্রাফার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯১৩ সালে সুকুমার কলকাতায় ফিরে আসেন। সুকুমারের ইংল্যান্ডে অধ্যয়নকালে উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী উন্নতমানের রঙিন হাফন্টোন ব্লক তৈরি ও মুদ্রণক্ষম একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন। এই সময় তিনি ছোটদের জন্য ‘সন্দেশ’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করেন। সুকুমার তাতে নিয়মিত লিখতেন। সুকুমারের বিলেত থেকে ফেরার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই উপেন্দ্র কিশোরের মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যুর পর সন্দেশ পত্রিকা ও পারিবারিক ছাপাখানা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় ছোট দুই ভাই ও পরিবারের সদস্যরা তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন এবং সন্দেশ-এর নানাবিধ রচনা করে তার পাশে দাঁড়ান।

সুকুমার রায়ের স্বল্প স্থায়ী জীবনে তার প্রতিভার শ্রেষ্ঠ বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। সন্দেশের সম্পাদক থাকাকালীন সময়ে তার লেখা ছড়া, গল্প ও প্রবন্ধ আজও বাংলা শিশুসাহিত্যে মাইলফলক হয়ে আছে। তার বহুমুখী প্রতিভার অনন্য প্রকাশ তার অসাধারণ ননসেন্স ছড়াগুলোতে। তার প্রথম ও একমাত্র ননসেন্স ছড়ার বই আবোল-তাবোল শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্ব সাহিত্যেও অনন্য।

প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়বার সময় তিনি ননসেন্স ক্লাব নামে একটি সংঘ গড়ে তোলেন। এর মুখপত্র ছিল সাড়ে বত্রিশ ভাজা নামে একটি পত্রিকা। সেখানেই তার আবোল-তাবোল ছড়ার চর্চা শুরু। পরবর্তীকালে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর মন্ডা ক্লাব (মানন্ডে ক্লাব) নামে একই ধরনের আরেকটি ক্লাব গড়েন তিনি।
মন্ডা ক্লাবের সাপ্তাহিক সমাবেশে সদস্যরা জুতো সেলাই থেকে চন্ডী পাঠ পর্যন্ত সব বিষয়েই আলোচনা করবেন। সুকুমার রায় মজার ছড়ার আকারে এই সাপ্তাহিক সভার কয়েকটি আমন্ত্রণ পত্র করেছিলেন সেগুলোর বিষয়বস্তু ছিল মুখ্যত উপস্থিতির অনুরোধ এবং বিশেষ সভার ঘোষণা ইত্যাদি।

ইতিমধ্যে সুকুমার প্রচ্ছদ শিল্পীরূপেও সুনাম অর্জন করেছেন। তার প্রযুক্তিবিদ্যা আয়ত্তের পরিচয় মেলে নতুন পদ্ধতিতে হাফটোন ব্লক তৈরি আর ইংল্যান্ডের কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত তার প্রযুক্তিবিষয়ক রচনা থেকে। সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কাজ ছাড়াও সুকুমার রায় ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের সংস্কারপন্থী গোষ্ঠীর অন্যতম তরুণ নেতা, রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাস সরল ভাষায় লিখেছিলেন সুকুমার রায়।

কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে সুকুমার রায় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে মাত্র সাইত্রিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট