একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (Artificial Intelligence) বিশ্বকে রূপান্তরিত করছে। শুরুতে এটি ছিল বিজ্ঞান কল্পকাহিনির একটি চমকপ্রদ ধারণা, কিন্তু আজ এআই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্মার্টফোনে ভয়েস কমান্ড থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা, ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা শিক্ষাক্ষেত্র—সর্বত্র এআই তার শক্তি ও প্রভাব বিস্তার করেছে।
বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে এআই-এর অগ্রগতি অভূতপূর্ব। শিক্ষার্থীরা আজ শুধু বইয়ের পাতা উল্টিয়ে নয়, বরং এআই-ভিত্তিক চ্যাটবট, লার্নিং অ্যাপ ও কনটেন্ট জেনারেটর ব্যবহার করে জ্ঞান আহরণ করছে। একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আর কষ্ট করে গ্রন্থাগারে যেতে হয় না—এআই এখন মুহূর্তেই কাঙ্ক্ষিত তথ্য দিয়ে দেয়, তাও বিশ্লেষণসহ।
শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি:
এআই অনেক শিক্ষার্থীর কাছে এক ‘ডিজিটাল টিউটর’। প্রেজেন্টেশন তৈরি, রিসার্চ পেপার খোঁজা, জটিল গণিত সমস্যার ধাপে ধাপে সমাধান—সবকিছুতেই এটি যেন এক অবিশ্বাস্য সহকারী। কেউ কেউ এআই ব্যবহার করে নিজের ইংরেজি দক্ষতা বাড়াচ্ছে, কেউ আবার সাহিত্যের জটিল বিশ্লেষণ বোঝার জন্য এর সাহায্য নিচ্ছে।
তবে এর উল্টো দিকও রয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী এআই-এর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। তারা নিজেদের চিন্তা প্রয়োগ না করেই এআই দিয়ে তৈরি করা কনটেন্ট জমা দিচ্ছে। এতে করে মৌলিকতা হারাচ্ছে, ঝুঁকি বাড়ছে ‘বুদ্ধিবৃত্তিক অলসতা’র।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এআই-এর ব্যবহার নিয়ে রয়েছে নানা মত। কেউ বলছেন এটি পড়ালেখায় সহায়ক, কেউ আবার এটিকে সৃজনশীলতার অন্তরায় মনে করছেন। আসুন জেনে নিই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের শিক্ষার্থীদের এআই বা Artificial Intelligence নিয়ে বিভিন্ন মতামত—
গণিত বিভাগের এক শিক্ষার্থী এ প্রসঙ্গে বলেন, “গাণিতিক সমস্যাগুলো অনেক সময় জটিল হয়ে যায়, বিশেষ করে যখন ধাপে ধাপে বিশ্লেষণ দরকার হয়। সে ক্ষেত্রে এআই খুবই সহায়ক। শুধু উত্তরই নয়, এটি প্রতিটি ধাপ ব্যাখ্যা করে বোঝায় এবং প্রয়োজনে উদাহরণও দেয়, যা অনেকটা একজন প্রাইভেট টিউটরের মতো কাজ করে। ক্লাসে যদি কোনো টপিক বুঝতে সমস্যা হয়, বাসায় এসে এআই-এর সাহায্যে সেটা পরিষ্কারভাবে বুঝে নিতে পারি। পাশাপাশি, বিভিন্ন উৎস থেকে প্রয়োজনীয় রিসোর্স খুঁজে পেতেও এটি অনেক সময় বাঁচায়।”
রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থীর কাছে এআই-নিয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ার সময় নানা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা, রাজনৈতিক দর্শন, ইতিহাস কিংবা সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে বিশ্লেষণ প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে এআই আমাকে খুব দ্রুত তথ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করে। বিশেষ করে যখন নির্দিষ্ট কোনো চিন্তাবিদের মতাদর্শ বা কোনো ঘটনার পেছনের কারণ জানতে চাই, তখন এআই প্রাসঙ্গিকভাবে সাজিয়ে দেয়। তবে আমি চেষ্টা করি, এআই থেকে পাওয়া তথ্য নিজের ভাষায় প্রকাশ করতে, যাতে চিন্তার বিকাশ হয়।”
শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি:
শিক্ষকদের একাংশ মনে করেন, এআই শিক্ষার্থীদের চিন্তা করার ক্ষমতা হ্রাস করছে। অনেক সময় তারা হুবহু কপি-পেস্ট করে এআই-এর দেওয়া কনটেন্ট ব্যবহার করছে, যা একদিকে একাডেমিক অসততা, অন্যদিকে নিজের জ্ঞান অর্জনের পথে অন্তরায়।
তাদের মতে, শিক্ষা শুধু তথ্য জানার নাম নয়, বরং শেখার প্রক্রিয়া, বিশ্লেষণ, বিতর্ক ও ব্যক্তিগত ব্যাখ্যার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। আর এআই সেই চিন্তার জায়গাটি দখল করে নিচ্ছে যদি আমরা এটিকে অন্ধভাবে অনুসরণ করি।
সুতরাং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষার্থীদের বন্ধু নাকি ফাঁকিবাজির সহায়ক তা নির্ভর করে ব্যবহারকারীর ওপর। এআই একটি শক্তিশালী টুল, কিন্তু সেটি কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটিই মূল বিষয়। আপনি চাইলে এআই-এর সহায়তায় নতুন কিছু শিখতে পারেন, নিজের চিন্তার পরিধি বাড়াতে পারেন। আবার কেউ চাইলে এটিকে শুধুই সময় বাঁচানোর জন্য তথ্য কপি করে পরীক্ষায় পাস করার উপায় হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
একজন দায়িত্বশীল শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের উচিত এআই-কে সহায়ক শক্তি হিসেবে দেখা—যেটি আমাদের শেখার গতি বাড়াবে, কিন্তু চিন্তার স্বাধীনতাকে গ্রাস করবে না।
এআই এখন আর ভবিষ্যতের কোনো কল্পনা নয়, এটি বর্তমানের বাস্তবতা। এ বাস্তবতাকে আমাদের গ্রহণ করতেই হবে। তবে যেভাবে গ্রহণ করব, সেটিই নির্ধারণ করবে—এআই হবে আমাদের জ্ঞানী বন্ধু, না কি সৃজনশীলতার শত্রু। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হওয়া জরুরি—যাতে তারা এআই-কে ‘উপকারী সহযোগী’ হিসেবে ব্যবহার করে, ‘বিকল্প মস্তিষ্ক’ হিসেবে নয়।
লেখকদ্বয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
পূর্বকোণ/জেইউ/পারভেজ