চট্টগ্রাম শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪

অনলাইন ব্যবসা: সম্ভাবনাময়, প্রয়োজন সহায়তা

৭ এপ্রিল, ২০২২ | ১:১৮ অপরাহ্ণ

মরিয়ম জাহান মুন্নী

পেশায় ব্যাংকার হলেও সানজিদা আফরোজের স্বপ্ন ছিলো দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করার। সেই ভাবনা থেকেই চাকরি ছেড়ে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ব্যবসায় নামেন তিনি। পড়াশোনার পাশাপাশি স্বাবলম্বী হওয়ার তাড়না থেকেই অনলাইনে মেয়েদের পণ্য বিক্রি শুরু করেছিলেন ফারিহা ইসলাম সুমাইয়া। এখন মেয়েদের পণ্য বিক্রির বড় ফেসবুক গ্রুপ পরিচালনা করছেন এই নারী।

তাসলিমা আক্তার তয়ার উদ্যোক্তা হয়ে উঠার গল্পটা একটু ভিন্ন। বাবা মারা যাওয়ার পর পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তিনি। খরচ যোগাতেই নামেন ব্যবসায়। কলেজ শিক্ষক সাগর দে চেয়েছিলেন অনলাইন ব্যবসায়ীদের এক প্ল্যাটফর্মে এনে প্রশিক্ষণ দিতে। এখন ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি নিজেও উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন এই শিক্ষক। তিনি প্রতিদিনের বাজার ডটকম-এর সিইও, সম্ভার ও বিজব্যাংক-এর কো ফাউন্ডার এবং রিক-এর মালিক।

সানজিদা, ফারিহা, তয়া ও সাগরের উদ্যোক্তা হয়ে উঠার পেছনের এসব গল্প ভিন্ন ভিন্ন হলেও তাদের স্বপ্ন ছিলো এক। নিজেদের সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা। কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে সেই স্বপ্নজয় করেছেন তারা। সম্প্রতি পূর্বকোণ কার্যালয়ে এসে স্বপ্নজয়ী এই উদ্যোক্তারা শুনিয়েছেন তাদের স্বপ্নপূরণের গল্প। কথা বলেছেন অনলাইন ব্যবসার চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে।

ব্যবসার সঙ্গে বেড়েছে বিড়ম্বনাও:
ওমেন এন্ড ই-কর্মাস ট্রাস্ট (উই) এর মডারেটর ও আলিজা বিডি’র উদ্যোক্তা সানজিদা আফরোজ বলেন, করোনা পরিস্থিতি শুরুর পর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তখন ব্যবসার বড় মাধ্যম হয়ে উঠে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। চাল, ডাল থেকে শুরু করে কাপড়, রান্না করা খাবার সবকিছুই অনলাইনের মাধ্যমে বেচাকেনা শুরু হয়। তৈরি হয় অনেক অনলাইন উদ্যোক্তা।

তিনি বলেন, অনলাইন ব্যবসার প্রসারের ফলে এখন ব্যাংক ঋণের প্রয়োজন হচ্ছে। কিন্তু সেখানে ট্রেড লাইসেন্সসহ নানা কাগজ চাইছে। কিন্তু একটা ট্রেড লাইসেন্স করতে হোল্ডিং ট্যাক্সের সাম্প্রতিক কপি লাগে। অথচ আমরা যারা ভাড়া বাসায় থাকি তাদের বাড়িওয়ালারা এসব দিতে চায় না। সরকারি প্রণোদনা নিতে গেলেও একই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে আমাদের।

মেমসাহেব গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ফারিহা ইসলাম সুমাইয়া বলেন, অনেকে ক্ষেত্রে সব কাগজপত্র ঠিক থাকলেও অনলাইন ব্যবসার কারণে ব্যাংক আমাদের ঋণ দেয় না। এমন একটি ঘটনা সম্প্রতি আমার সাথেই ঘটেছে। ব্যাংকের সব শর্ত পূরণ করার পরও অনলাইন ব্যবসায়ী হওয়ায় আমাকে ঋণ দেয়নি। নানা জায়গায় আমাকে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে।

সহায়তা পেলে বড় কিছু সম্ভব :
তয়া মার্টের উদ্যোক্তা তাসলিমা আক্তার তয়া বলেন, অনলাইন ব্যবসায়ীদের জন্য সহজভাবে লোনের ব্যবস্থা করলে উদ্যোক্তারা এগিয়ে যেতে পারবে। তারা অনলাইন থেকে দৃশ্যমান প্রতিষ্ঠানের মালিক হতে পারবে। যদি কোনো সহযোগিতা পাওয়া না যায় তাহলে বড় কিছু করা সম্ভব নয়। অনলাইন ব্যবসা সম্প্রসারণ হলে দেশ লাভবান হবে। সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়বে।

চিটাগং ই-কমার্স ফ্যামিলি (সেফ) এর এডমিন সাগর দে বলেন, ই-কমার্সকে উন্নত করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনেকগুলো প্রকল্প আছে। ইতোমধ্যে সরকার ১২ হাজার উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। আগামীতে এসব প্রশিক্ষণ আরো বাড়াতে হবে। অনলাইন ব্যবসাকে আরো এগিয়ে নেওয়ার জন্য উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তি নির্ভর জিনিসপত্র দিতে হবে।

সচেতনতা বাড়লে কমবে প্রতারণা :
সানজিদা আফরোজ বলেন, অনলাইনে কিছু বড় প্রতিষ্ঠান মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে- এটা সত্যি। তবে সবাই তো আর নেয়নি। এখন ক্রেতারা অনেক সচেতন। তারা ভালো মন্দ বুঝে। রিভিউ দেখে বিশ্বস্ত পেজ বা গ্রুপ থেকে কেনাকাটা করে। সচেতনতা আরও বাড়ানোর পাশাপশি সরকার নীতিমালা করে দিলে প্রতারণা কমে আসবে।

ফারিহা ইসলাম সুমাইয়া বলেন, প্রতারণা ঠেকাতে এখন ক্যাশ অন ডেলিভারিকে প্রাধান্য দিতে হবে। তবে অনেক সময় ক্যাশ অন ডেলিভারির ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাকে ঠকতে হয়। এক্ষেত্রে পণ্যের জন্য কিছু টাকা অগ্রিম বিকাশ করে বাকি টাকা পণ্য পাওয়ার পর দেওয়ার পদ্ধতি মেনে চলা দরকার। পেজের রিভিউ যাচাই করেও প্রতারণা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

পণ্য ডেলিভারি বড় চ্যালেঞ্জ :
সাগর দে বলেন, পণ্য ডেলিভারির ক্ষেত্রে কিছু সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ক্যাশ অন ডেলিভারিতে পণ্য পাঠানোর পর দেখি- ক্রেতা সেটি নিতে চান না। এখন কিছু ডেলিভারি কোম্পানি এসেছে। যাদের কোনো লাইসেন্স নেই। এ ক্ষেত্রে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি। এ ডেলিভারি গ্রুপগুলোকে যদি লাইসেন্সের আওতায় আনা যায়, তবে পণ্য ডেলিভারির ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে পারবো।
তিনি বলেন, এখন মানুষ ঘরে বসে পণ্য কেনাকাটা করে সময় এবং শ্রম বাঁচানোর জন্য। এক্ষেত্রে অনলাইন ডেলিভারির আরেকটি ভালো দিক হচ্ছে- এখানে আরো কিছু মানুষের কাজের ব্যবস্থা হয়েছে। অনেকে এটিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। আগে মানুষ লজ্জা পেতো। কিন্তু এখন অনেকে এটিকে ভালোবেসে পেশা হিসেবে নিচ্ছে।

পরিচয়ের সঙ্কট কাটাতে হবে :
তাসলিমা আক্তার তয়া বলেন, পড়াশোনা শেষ করে অনলাইন ব্যবসাকে অনেকের পরিবার সমর্থন করে না। বিশেষ করে নারীদের নানা কথা শুনতে হয়। তাই আমাদের লড়াইটা একটু বেশি কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু দেখা যায় একসময় আমরা ঠিকই ভালো কিছু করছি। তখন কিন্তু তারা বাহবা দেয়।
সাগর দে বলেন, অনলাইন ব্যবসার সাথে জড়িতরা এখনো পরিচয়হীনতায় ভুগে। এতে অনেকে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। মাঝপথে হারিয়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে উদ্যোক্তা হয়ে উঠার বড় প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে অনলাইন ব্যবসা। অথচ ভালো একটি মাধ্যমে ব্যবসার পরও সমাজ এটিকে সম্মানের চোখে দেখছে না।

 

পূর্বকোণ/এস

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট