চট্টগ্রাম বুধবার, ১৮ জুন, ২০২৫

সর্বশেষ:

ফাইল ছবি

আলোকের এই ঝর্ণাধারা

দেবাশীষ মজুমদার

২৮ মে, ২০২৫ | ১:৫১ অপরাহ্ণ

সিনেমা কেবল আনন্দের আয়োজন নয়—তা অনেক সময়েই এক অন্তর্লীন ভাষা, যা উচ্চারিত হয় দৃষ্টির মধ্য দিয়ে, প্রতিধ্বনিত হয় নীরবতায়। যখন এক নির্মাতা বাজার ও প্রতিষ্ঠানের গণ্ডি পেরিয়ে নিজস্ব রসায়নে দৃশ্য নির্মাণ করেন, তখন সেখানে জন্ম নেয় এক বিকল্প ধারার সিনেমা। এ সিনেমা আলো চায় না, বাহবা নয়; সে টিকে থাকে প্রশ্নের মধ্যে, অনিশ্চয়তার পাশে।

 

এই ধারার নাম—ইন্ডিপেনডেন্ট সিনেমা। এই সিনেমার উত্থান একদিনে হয়নি। এর সূচনা ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী (post-World War II) বাস্তবতার ভেতর, যেখানে সমাজব্যবস্থা ও শিল্পে এসেছিল নতুন মাত্রা। বাংলাদেশে এর বীজ রোপিত হয়েছিল স্বাধীনতা-উত্তর বিভ্রান্তি, রাষ্ট্র গঠনের টানাপোড়েন, আর সাংস্কৃতিক খাদের প্রেক্ষাপটে।

 

এই পথিকৃতদের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিলেনআলমগীর কবির। ধীরে বহে মেঘনা, সীমানা পেরিয়ে, পুরস্কার—এমন ছবি নির্মাণ করে তিনি দেখিয়েছেন চলচ্চিত্র কেবল বিনোদন নয়, বরং জাতিগত বোধ আর মানবিক দায়ের বহমান ধারক। তাঁর কাজ ছিল রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও নান্দনিক কাব্যিকতার মেলবন্ধন। এর পরে আসে আশির দশকের নবজাগরণ।মোরশেদুল ইসলামতাঁরআগামীদিয়ে দেখান কীভাবে সীমিত সম্পদেও বলা যায় অনতিক্রমণীয় কথা।চাকা–র মতো চলচ্চিত্র নিছক শিল্প নয়, হয়ে ওঠে সময়ের ধারাভাষ্য।

 

তানভীর মোকাম্মেলএই ধারার আরেক উল্লেখযোগ্য নির্মাতা।নদীর নাম মধুমতি, লালসালু, চিত্রা নদীর পারে—তাঁর প্রতিটি কাজই যেন ইতিহাস ও ব্যক্তিগত স্মৃতির ভেতর চলমান এক অন্তর্দর্শনের অভিযান। তাঁর সিনেমা গভীর, রাজনৈতিক এবং বহুভাবনায় প্রজ্বলিত। এই ধারায় নব্বই দশকে আসে নতুন গতিতারেক মাসুদেরহাত ধরে।মাটির ময়নাকেবল একটি সিনেমা নয়, এটি বাংলাদেশের একটি সাংস্কৃতিক দলিল। Cannes (কান) আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নির্বাচিত হওয়া এই ছবি প্রমাণ করে, বাংলাদেশের গল্পও বিশ্বমঞ্চে ধ্বনিত হতে পারে।

 

এরপরমোস্তফা সরয়ার ফারুকীএকটি নতুন ঢেউ আনে।ব্যাচেলর, টেলিভিশন, মেড ইন বাংলাদেশ—এই ছবিগুলোর মাধ্যমে তিনি দেখান, নাগরিক জীবন, ধর্ম, মিডিয়া ও আধুনিকতার দ্বন্দ্ব নিয়ে নির্মিত গল্পও আন্তর্জাতিকভাবে প্রাসঙ্গিক হতে পারে।

 

এই ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করেছেন আরও অনেকে। যেমন, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, যিনি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘গেরিলা’ ও ‘একাত্তরের যীশু’ নির্মাণ করে স্বাধীন ধারার সিনেমাকে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব দিয়েছেন,, আবির রহমান, সাব্বির নাসির, মোহাম্মদ আলী মুনতাকিম—যাঁদের নির্মাণকাজ নিয়মিতভাবে সমালোচকদের আলোচনায় না এলেও তাঁরা বিকল্প কাঠামোয় চলচ্চিত্র নির্মাণ করে গেছেন।

 

নতুন শতকের নবস্বর স্বাধীন চলচ্চিত্রের সাম্প্রতিক সাফল্যগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যআব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদপরিচালিতরেহনুমা মরিয়ম নূর। এটি ২০২১ সালেCannes Film Festival-এরUn Certain Regardবিভাগে নির্বাচিত হয়, যা ছিল কোনো বাংলা ভাষার প্রথম চলচ্চিত্রের এমন স্বীকৃতি। এক একক চরিত্রকেন্দ্রিক এই দৃঢ়চেতা সিনেমাটি শুধু নারী অভিজ্ঞতার নয়, নৈতিক সংকট ও সামাজিক চাপের মধ্য দিয়ে একজন ব্যক্তির নির্ভীক অবস্থানের কাহিনি।

 

এই ধারারই এক সাম্প্রতিক চূড়ান্ত সাফল্য‘আলী’।আদনান আল রাজীবপরিচালিত এই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি ৭৮তম কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে La Cinefবিভাগে‘বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছবি’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ছবি, যা কানের অফিসিয়াল শর্টফিল্ম প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত হয়ে এমন স্বীকৃতি অর্জন করলো।

 

বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত এই সিনেমায় এক কিশোর গায়কের কণ্ঠ লুকিয়ে রাখা—শব্দহীন প্রতিরোধের এক রূপ হয়ে ওঠে। এই স্বীকৃতিগুলো প্রমাণ করে, স্বাধীন সিনেমা শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও একটি শক্তিমান কণ্ঠ হয়ে উঠছে।

 

২০২৩ সালের ডিসেম্বরে, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে অনুষ্ঠিত একটি প্রদর্শনীতে ৯টি স্বল্পদৈর্ঘ্য স্বাধীন চলচ্চিত্র দেখানো হয়। এই আয়োজন করেছিল তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের পুনর্গঠনের জন্য গঠিত জাতীয় অনুসন্ধান কমিটি, সহযোগিতায় জাতীয় ফিল্ম আর্কাইভ।

 

মাহাদী হাসান-এর A Boring Film নির্বাচিত হয়েছে Locarno (লোকার্নো)-তে, আরিক আনাম খানের ‘Transit’গেছে Busan (বুসান)-এ, দেবাশীষ দাস-এর NiruddeshJatra জিতেছে Prague (প্রাগ)-এ। আরও ছিলেনতাসমিয়াহ আফরিন মৌ, মোহাম্মদ তৌকির ইসলাম, গোলাম রাব্বানী, হাসিব শাকিল ও জায়েদ সিদ্দিকী, এবংআল হাসিব খান আনন্দ।

 

সবচেয়ে আলোচিত ছিলশাহ নেওয়াজ খান সিজু-র Not A Fiction, এক শটে নির্মিত একটি দৃঢ় রাজনৈতিক ভাষ্য, যা ইতোমধ্যেই তিনটি Oscar-qualifying festival-এ নির্বাচিত হয়েছে।

 

সিনেমা ও জাতীয় চেতনার পারস্পরিক বিন্যাস : স্বাধীন সিনেমা অনেক সময়েই ব্যক্তিগত হয়ে পড়ে। কিন্তু এর প্রতিটি শিকড় গাঁথা থাকে বৃহত্তর সামাজিক বাস্তবতায়। Routledge (রাউটলেজ)থেকে প্রকাশিত Identity, Nationhood and Bangladesh Independent Cinema বইটিতেলুৎফর রহমান হক ও ব্রায়ান শুস্মিথদেখিয়েছেন, কীভাবে বাংলাদেশের ইন্ডিপেন্ডেন্ট চলচ্চিত্র নির্মাতারা রাষ্ট্রকেন্দ্রিক জাতীয়তার ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে বহুমাত্রিক ব্যক্তিক ও অঞ্চলিক পরিচয় নির্মাণ করছেন। ResearchGate-এ প্রকাশিত প্রবন্ধেও এই নির্মাণগুলোর সমাজবীক্ষণ ও আত্মনিরীক্ষণমূলক দিক গভীরভাবে আলোচিত হয়েছে।

 

সীমার মাঝে সম্ভাবনা : Dhaka International Film Festival (DIFF)এখন স্বাধীন নির্মাতাদের অন্যতম মঞ্চ হলেও, এর কাঠামো এখনও মূলত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের দিকেই বেশি মনোযোগী। তবু এখানেই উঠে আসেমোহাম্মদ কাইয়ুম-এরকুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া, যা হাওর অঞ্চলের জীবন নিয়ে তৈরি এক চিত্রকাব্য।

 

রুবাইয়াত হোসেন-এরমেহেরজান, আন্ডার কনস্ট্রাকশন, ওমেড ইন বাংলাদেশআন্তর্জাতিকভাবে প্রদর্শিত হয়ে নারী, শ্রম ও আধুনিকতার দ্বন্দ্বকে নতুন আলোকপাত করে। চরকি, বিঞ্জ-এর মতো ওটিটি প্ল্যাটফর্ম কিংবাBerlinale Talents, Raindance, Cinemartইত্যাদি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সুযোগগুলো নতুন নির্মাতাদের নিজের দর্শক গড়ার পথ করে দিচ্ছে।

 

গৃহত্যাগী নির্মাণচেতনা : এই ছবিগুলোর অধিকাংশই দেশে কোনো বাণিজ্যিক সিনেপ্লেক্সে চলার সুযোগ পায় না। বরং বিকল্প প্রদর্শনীর ব্যবস্থা, উৎসব, কিংবা ঘরোয়া স্ক্রিনিংয়ের মধ্যেই এগুলোর আবর্তন ঘটে। লগ্নির অপ্রতুলতা, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, সেন্সর বোর্ডের তীক্ষ্ণ নজর এবং মূলধারার দর্শকপ্রত্যাশার বাইরে অবস্থান—সব মিলিয়ে এই নির্মাতাদের যাত্রা সহজ নয়। তবু তাঁরা নির্মাণে স্থির, প্রায় জেদি। যেন একধরনের বাউল, যারা সংসার, স্বীকৃতি, এমনকি নিশ্চিন্ত ভবিষ্যতের মোহ ছেড়ে কেবল নন্দনের পেছনে হাঁটে। তাঁদের অনন্ত সাধনা শুধুই ভাল সিনেমা বানানো, যা সত্য ও সৌন্দর্যের সংমিশ্রণে নির্মিত। এই নির্মাণ এক পবিত্র উন্মাদনা—প্রচণ্ড এক সৃষ্টিশীলতা, যা শৃঙ্খল ছাড়াই আত্মপ্রকাশ করে।

 

আলোর থেকেও গাঢ় যা কিছু : এই নির্মাতারা ‘হিট’ ছবি বানান না। তাঁদের প্রচার নেই, প্রিমিয়ার নেই, রঙিন ব্যানারও খুব একটা না। তবু তারা আছেন—কারণ তাঁরা জরুরি। বাংলাদেশের এই অসমবয়সী নির্মাতারা মিলে গড়ে তুলছেন এমন এক ধারা, যা বাজার নয়, বোধের গভীর অঞ্চলকে কেন্দ্র করে।তাঁদের ধ্যান জ্ঞান কেবল সিনেমা এবং সিনেমা। এদের সিনেমা শোরগোল করে না, তারা নিঃশব্দে জমে থাকে—যেন ভবিষ্যতের জন্য ফেলে রাখা এক সুনির্দিষ্ট ভাষা। এই নির্মাতারা বাজার এর সাথে সম্পৃক্ত নয়, বরং তাঁদের সিনেমা তাঁদেরবোধকে কেন্দ্র করে তৈরি—যেন অজানা কোনো ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে লেখা এক চিঠি, যা আজ নয়, কাল খুলে পড়বে কেউ।

 

এই সিনেমা দেখা নয়, অনুভব করার বিষয়। তা চিৎকার করে না, ধীরে ছড়িয়ে পড়ে মনের এমন এক কোণে, যেখানে ভাষা পৌঁছায় না। পৌঁছাতে পারে না । ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও/আপনাকে এই লুকিয়ে-রাখা ধুলার ঢাকা/ধুইয়ে দাও…’—এই নির্মাণগুলো যেন সেই গোপন আত্মপ্রার্থনার মতো, যা উচ্চারিত হয় না, কিন্তু এক গভীর, স্থায়ী ছাপ রেখে যায়।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট