আজ ২৫ বৈশাখ । কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৮তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৬১ সালের ২৫ শে বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ৮০ বছরের জীবনকালে তিনি ছিলেন একাধারে কবি, নাট্যকার, কথাশিল্পী, চিত্রশিল্পী, গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক, ছোট গল্পকার ও ভাষাবিদ। বাংলাসাহিত্য-সংস্কৃতিরএমন কোনো দিক নেই যা নিয়ে তিনি লেখালেখি করেননি। মানুষের মুক্তির দর্শনই তাঁর লেখনির মূলমন্ত্র। ঠাকুর পরিবারের জমিদারি পরিবেশে কড়া নিয়ম শৃঙ্খলায় বেড়ে উঠলে ও তিনি
অত্যন্ত নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেছেন সাধারণ মানুষ আর বিশ্ব প্রকৃতিকে।
আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতিলাভ করেন। লিখেছেন বাংলা ও ইংরেজি ভাষায়। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের পাঠ্যসূচিতে তার লেখা সংযোজিত হয়েছে। ১৮৭৮ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ কবিকাহিনী ’প্রকাশিত হয়। এ সময় থেকেই কবির বিভিন্ন ঘরানার লেখা দেশ-বিদেশে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পেতে থাকে। ১৯১০ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘গীতাঞ্জলী’ কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে তিনি সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯১ সাল থেকে পিতার আদেশে কুষ্টিয়ার শিল্াইদহে, পাবনা, নাটোরে এবং উরিষ্যায় জমিদারীগুলো তদারকি শুরু করেন কবি। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। তিনি ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ত্রিশটিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন।
তাঁর মৌলিক কাব্যগ্রন্থ ২৫টি। তবে বাঙালি সমাজে তার জনপ্রিয়তা সংগীতেও রয়েছে। তিনি দুই হাজার গান রচনা করেন। অধিকাংশ গানে সুরারোপ করেন। তার সমগ্র গান ‘ গীতবিতান’ গ্রন্থে রয়েছে। কবির লেখা ‘ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। ভারতের জাতীয় সংগীতটিও কবির লেখা। জীবিতকালে তার প্রকাশিত মৌলিক কবিতাগ্রন্থ হচ্ছে ৫২টি, উপন্যাস ১৩টি, ছোটগল্প’র বই ৯৫টি, প্রবন্ধ ও গদ্যগ্রন্থ ৩৬টি, নাটকের বই ৩৮টি। কবির মত্যুর পর ৩৬ খ-ে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী ’ প্রকাশ পায়। এ ছাড়া ১৯ খ-ের রয়েছে ‘ রবীন্দ্র চিঠিপত্র।’ ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত কবির আঁকা চিত্রকর্ম’র সংখ্যা আড়াই হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে ১৫৭৪টি চিত্রকর্ম শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে। কবির প্রথম চিত্র প্রদর্শনী দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উদ্যোগে ১৯২৬ সালে প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয়।
তাঁর কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধগুলোতে রয়েছে সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজস্ব মতামত ও মানুষের আকাংখার প্রতিফলন। প্রগতিশীল, শিক্ষিত দেশ ও জাতি এবং বিশ্ব গঠনের বাণীও অকিাংশকর্মে পরিস্ফূট হয়েছে। কবির জন্মের পর দেড় শতাধিক বছর অতিক্রান্ত হলেও তার সৃষ্টিকর্ম দেশ-বিদেশে আজও সমধিক সমাদৃত রয়েছে বলে রবীন্দ্র গবেষকরা বিভিন্ন পুস্তকে মতামত রেখেছেন।
কবির ছোটগল্পগুলো বাংলাসাহিত্যের অমূল্য এক সম্পদ। উপন্যাস যথাক্রমে ঘরে বাইরে, গোরা, বৌঠাকুরাণির হাট, স্ত্রীর পত্র, শেষের কবিতা কবির অনবদ্য সৃষ্টি।
একেবারে শৈশবে ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লিখে রবীন্দ্রনাথের কাব্য প্রতিভার স্ফূরণ ঘটে। তারুণ্য আর যৌবনে লেখা কবিতাগুলো ভরা রোমন্টিসিজমে। কল্পনার পাখায় ভর করে কবি তাঁর মানসসুন্দরীকে খুঁজতে চলে গেছেন দূরে বহুদূরে স্বপ্নলোকের উজ্জ্বয়িনী পুরে : ‘ দূরে বহুদূরে, স্বপ্নলোকের উজ্জ্বয়িনীপুরে/ খুঁজিতে গেছিনু কবে শিপ্রা নদী তীরে/ মোর পূর্বজনমের প্রথমা প্রিয়েরে’। কিন্তু তিনি দেখেন ‘জীবনদেবতা’ নামের এক অশরীরি শক্তি তাঁকে আবার কল্পনার জগৎ থেকে বিচ্যুৎ করে মর্ত্যে নামিয়ে আনেন । তিনি সীমা আর অসীমের দোলাচলে ঘুরতে ঘুরতেই জীবনের ৮০টি বছর পার করে দেন। একবারে চিরবিদায়কালে ও কবি লিখেছিলেন : প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিলো , কে তুমি? মেলেনি উত্তর, বৎসর বৎসর চলিয়া গেল, দিবসের শেষ সূর্য শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল , পশ্চিম সাগরতীরে, নিস্তব্ধ সন্ধ্যায় , কে তুমি পেল না উত্তর।