চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৪

সর্বশেষ:

গ্রন্থ-সম্পৃক্ততাই মানুষের সুন্দর হওয়ার সোপান

অনলাইন ডেস্ক

২৮ আগস্ট, ২০২৩ | ১০:৫৮ অপরাহ্ণ

গ্রন্থ-সম্পৃক্ততাই জ্ঞান সমৃদ্ধির একটি সুন্দর সোপান। এই সোপানই সারা জীবনের হওয়া জরুরি; যা জ্ঞানান্বেষণের পথ। জীবনের অনিবার্য সত্য-সুন্দর এই সোপানই ব্যক্তি, সমাজ তথা দেশের জন্য কল্যাণকর আবহ। এই সোপানই জ্ঞানালোকিত মানসভূমি তৈরি করে দেয়, যা গ্রেট ব্রিটেনে হয়েছে।

আবদুল হাইয়ের ‘বিলাতে সাড়ে সাতশ দিন’ গ্রন্থে তার উল্লেখ আছে। সেখানে বাড়িতে বাড়িতে বাধ্যতামূলক পাঠকক্ষ রাখার বিধান পাকাপোক্ত। এই সোপানে কিশোর বয়স থেকেই সম্পৃক্ত শুরু হওয়া জরুরি। মানুষের মানসিক উন্নয়নে সত্য-সুন্দরের চর্চা, সত্যকথনের চর্চা, সুন্দর সংস্কৃতিবলয়ের চর্চা থাকতে হয়। ‘অ্যান ইংলিশ নেভার টেল আ লাই’— ইংরেজদের সম্পর্কে পৃথিবীতে প্রবাদপ্রতিম এই বাণী খুবই প্রশংসিত হয়ে আছে। কিশোর বয়সে সত্ অভিভাবকত্বের সুন্দর ছোঁয়া ও চর্চা তাদের সুসভ্য করে গড়ে তোলে। সুন্দর মনোবৃত্তির মানুষ তৈরি করে। এ কারণে ঐ দেশে জনে-জনে সচ্চিন্তার প্রবাহ বহমান। অস্বস্তির কোনো নাজুক পরিস্থিতি সেখানে তৈরি হয় না। তাদের মানসভূমে শেকসপিয়ার-বার্নার্ড শ-শেলি-বায়রনের মতো লেখকের অবস্থান সুদৃঢ়।

এখানে গ্রন্থ-সম্পৃক্ততার একটি ঘটনা উল্লেখ করার মতো, যা মনকে আশান্বিত-আপ্লুত করে। দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবেসে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কর্ণধার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ নিরলস কাজ করে চলেছেন। মানুষকে আলোকিত করার ব্রত গ্রহণ করেছেন। সুন্দর মহৎ ব্রত। জনে-জনে গ্রন্থ-সম্পৃক্ততা গড়ে উঠুক—এই লক্ষ্য নিয়ে তিনি কাজ করছেন। এই কর্মযজ্ঞে তার বিশাল অভিভাবকত্বের প্রমাণ মেলে। আমাদের দেশটা মানসিক বৈকল্যমুক্ত সুন্দর সুসভ্য মানুষের দেশ হোক—এটাই তার চাওয়া। মানসিক উন্নয়নের আলোকবর্তিকারূপে তিনি দীপ্যমান। ‘আলোকিত মানুষ চাই’—এটি তার সুফলপ্রসূ মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ।

সুসভ্য জাতি হওয়ার পেছনে গ্রন্থের ভূমিকা অপরিসীম—এই উপলব্ধি থেকে তিনি এই কাজে নিবেদিত ও উদ্বুদ্ধ। ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি করেছেন তিনি, যা সারা দেশে চলমান। কিন্তু মানুষের সম্পৃক্ততা এখানে তেমন আশানুরূপ হচ্ছে না। কেমন একটা আশাহত ব্যাপার। দেশে বিদ্যার্জন হচ্ছে এবং শিক্ষিতজনের সংখ্যাও বাড়ছে। তার পরেও কেন সৃজনশীল বইপাঠে মানুষের আগ্রহ এত কম? বইমেলার অবস্থাও নাজুক। বই বিক্রি কম, যা হতাশাব্যঞ্জক। প্রকাশকদের আশাহীনতা লক্ষ করার মতো। বইয়ের প্রতি মানুষের টান কম। ব্যাপার হলো, বইবিমুখ হওয়ার পেছনে অনাভ্যাসই দায়ী। বই বিক্রি না হওয়ার মূল কারণ।

সেদিন পত্রিকায় দেখলাম, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নামের সঙ্গে ‘সাহিত্য’ শব্দটি সংযোজন করে সাহিত্য-সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় করার কথা। খবরটি দারুণ আপ্লুত হওয়ার মতো। এতে সাহিত্য-সংস্কৃতির বলয়টা বহুধাবিস্তৃত হবে। ক্ষেত্রটাও তৈরি হবে। আমাদের দেশের সাহিত্য যেন কেমন এক অন্ধকারে পড়ে থাকে। দেশের আলোকিত আখ্যান হয়ে আসাটা তার যেন হয়ে ওঠে না। আমরা অভিভূত হই, পৃথিবীতে অনেক পাঠকপ্রিয় বইয়ের গল্প শুনে। লাখ লাখ কপি বিক্রির হিড়িক আমাদের অবাক করে দেয়। আমার প্রশ্ন, এত পাঠকপ্রিয়তা কীভাবে অর্জন করে বইটি? আমার ধারণা, বইটির লেখা মনকে টেনে ধরার মতো। আকর্ষণ করার মতো শক্তিসম্পন্ন। সাহিত্যবোদ্ধা কর্তৃক নির্বাচিত। অতঃপর তার পাঠকপ্রিয়তা অর্জনের এবং কালজয়ী হওয়ার ঘটনা আমাদের মোহিত করে। সেই সঙ্গে পাঠকের অন্তররাজ্য বিশুদ্ধতায় ভরিয়ে তোলার কাজ শুরু হয়। এ রকম অনেক কালজয়ী বই পৃথিবীর সম্পদ।

আমার মনে হয়, একটি বিধান প্রণয়ন এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। তা হলো আমাদের দেশের সৃজনশীল বই—যেগুলো অত্যন্ত ভালো মানের বিবেচিত হবে, সেগুলো নির্বাচিত করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের বিদ্যালয়গুলোতে রাখার বিধান করা। এর উদ্যোক্ততা রাষ্ট্রকেই হতে হবে। এখানেই কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীল বইপড়ার প্রবণতা সৃষ্টি হবে। সপ্তাহান্তে পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল সাহিত্য ধরিয়ে দিলে তারা ধীরে ধীরে এই পাঠেও অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। এভাবে পাশের পড়ার সঙ্গে মানসিক সমৃদ্ধিও লাভ হবে। এই অভ্যাসটা হওয়া খুবই জরুরি।

এই কাজটা সাহিত্য-সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র করতে পারে। কেননা, এই প্রতিষ্ঠান সৃজনশীল পাঠক সৃষ্টির গ্রন্থ-সম্পৃক্ততার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এরকম মনোবৃত্তির আবহ তৈরিতে প্রতিষ্ঠানটি উপযুক্ত। সাহিত্যবোদ্ধা নির্বাচক মণ্ডলীও প্রতিষ্ঠানটি করে নিতে পারে। যাদের মাধ্যমে ভালো মানের বই নির্বাচিত হবে। এই কর্মপরিকল্পনায় বিমূর্ত চিন্তার কল্যাণকর একটি আবহ তৈরি হবে। সুচিন্তাপ্রসূত ভালো মানের বই রচনায়ও লেখক আত্মমগ্ন হতে উত্সাহিত হবেন। প্রকাশকেরা লাভবান হবেন। লেখক তার শ্রমলব্ধ প্রাপ্তিতে প্রশান্তি লাভ করবেন। পাঠকপ্রিয় বইয়ের সংখ্যা বেড়ে যাবে। কালজয়ীও হয়ে যাবে কোনো কোনোটি। পাপাচারে সিক্ত-ক্লেদাক্ত পরিবার, সমাজ, দেশ তথা পৃথিবী হবে প্রশমিত সুন্দর। প্রাণিকুল হবে নিরাপদ।

সাহিত্যসম্পৃক্ততার প্রসঙ্গ নিয়েই আমার এত কথার অবতারণা। বিদ্যার্জন মানুষের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি মৌলিক বিষয়, যা অর্জনের আবশ্যকতাকে অস্বীকার করা যায় না। বিদ্যার্জনটা জ্ঞানসংবলিত এবং বুদ্ধিবিবেচনাপ্রসূত হওয়া বাঞ্ছনীয়। পেটে বিদ্যা গজগজ গিজগিজ করলেই হয় না। জ্ঞানার্জনের মনোবৃত্তি থাকাই শ্রেষ্ঠ গুণ। কেননা, সম্পদের চেয়ে জ্ঞানই উত্তম। জ্ঞানই মনুষ্যত্ব ও ধর্ম। মানুষকে ‘মানুষ’ করার গ্রন্থ-সম্পৃক্ততা তাই জরুরি। মহানবি হজরত মুহাম্মদ (স.) হেরা গুহায় প্রথম যে বাণীটি পান, তা ছিল ‘পড়ো’। পড়া সম্পর্কিত। জগদ্বিখ্যাত ঔপন্যাসিক লিউ তলস্তয় পড়ার অনিবার্যটা ভালো করেই উপলব্ধি করেছিলেন। তা অনিবার্য সত্য হয়ে তার কাছে এসেছিল। তিনি বলেছেন, পৃথিবীর অস্থায়ী মানুষগুলোর কোনটা বেশি প্রয়োজন? তিনি বলেছেন, জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন, তা হলো বই, বই আর বই।

এই পড়াটা জনে-জনে থাকা বাঞ্ছনীয়। তবে হ্যাঁ, এই বিষয়টার মধ্যে বিভাজনরেখা মানুষের মধ্যে সতত পরিলক্ষিত। মানুষের মস্তিষ্কের কার্যাবলি-সংবলিত জীবনাচরণ একরকম; আর হূদয়মথিত কার্যাবলির আচরণ অন্যরকম। মস্তিষ্কসংবলিত আচরণ স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতায় ভরা। হূদয়সংবলিত আচরণ পরার্থপরতা ও আত্মোত্সর্গতায় দৃশ্যমান। জ্ঞানকে পেছনে ফেলে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থকরীর সঞ্চয় স্তূপকৃত গোবরের মতো, যা দুর্গন্ধ ছড়ায়। কল্যাণের কাজে আসে না।

মানুষের প্রবৃত্তির মধ্যে ভালোমন্দ দুই-ই বিদ্যমান। এটা সহজাত। কেউ হয়তো জিনগতভাবে ভালো, কেউ হয়তো মন্দ। প্রকৃতিপ্রদত্ত নিয়ম। এই ভালোরাই পৃথিবীতে গ্রন্থ এনেছে। এরা সচ্চিন্তার ধারকবাহক। ভালোর সঙ্গে এদের পথচলা। মন্দদের গ্রন্থ-সম্পৃক্ত সোপানে টেনে আনা এদের ব্রত। গ্রন্থের সুন্দর চরিত্রের ছোঁয়ায় মন্দেরা ভালো হয়ে ওঠে। এখানেই গ্রন্থের অনিবার্যতা অবধারিত। অজ্ঞানতাই নাজুক অবস্থার জন্য দায়ী। এর ভূরিভূরি দৃষ্টান্ত পৃথিবী জুড়ে। স্রষ্টা চান মানুষ জ্ঞানী হয়ে তার কাছে ফিরে আসুক। স্রষ্টার অধিষ্ঠান জ্ঞানীদের হূদয়ভূমি।

পৌরাণিক একটি গল্পে আছে—ব্রহ্মা ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করে সব সৃষ্টিকুলকে ডাকলেন। বললেন, তোমরা কে কী চাও, আমাকে বলো। তারা সাগর-মহাসাগর, গভীর অরণ্যানিসহ সবকিছু ভাগ করে নিল। শুধু একদল মনুষ্যসন্তান কিছুই নিল না। তারা বিমুগ্ধ-বিস্মিত-নিরাসক্ত-নির্লিপ্ত অবলোকনে স্রষ্টার পানে তাকিয়ে ছিল। সৃষ্টিকুল ব্রহ্মাকে বলল, ওরা কারা? কিছুই তো নিল না। ব্রহ্মা বললেন, ওরা কবির দল, ওরা প্রেমময়-নিরাসক্ত। ওদের হূদয়ভূমি স্রষ্টার অধিষ্ঠান।

প্রকৃতির এই সন্তানেরাই পৃথিবীতে গ্রন্থ এনেছে। মানুষকে জ্ঞানের পথে টেনেছে। এই গ্রন্থরাজিই চিন্তার স্বচ্ছ জলের প্রবহমান ধারা। এখানে স্নানসিক্ত ব্রতচারীরা সুন্দর মনের অধিকারী। সাহিত্য-সম্প্রীতির বন্ধনে এরা মোহাবিষ্ট সব সময়। গ্রন্থ-সম্পৃক্ততাই মানুষের সুন্দর হওয়ার সোপান। চলুন, এই সোপান ধরেই আমরা কল্যাণময় জীবনের পথে সতত চলমান থাকি। সৌজন্য: ইত্তেফাক

লেখক: আবুল কাসেম, সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক।

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন