চট্টগ্রাম সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

’৭০ এর নির্বাচন ছিল বাঙালি জাতির টার্নিং পয়েন্ট

পূর্ব প্রকাশিতের পর

নাওজিশ মাহমুদ

২৪ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:৩৭ পূর্বাহ্ণ

পাকিস্তানের ক্ষমতসীন সামরিক শাসক সামান্যতম আাঁচও করতে পারে নি, বাঙালিরা এভাবে এককভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং আওয়ামলীগকে ভোট দেবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে দায়ের করা আগরততলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের মাধ্যমে তাঁদের পিছু হটা শুরু হয়। ৭০ এর নির্বাচনের মাধ্যমে আইনগতভাবে বৈধ একটি শক্তিকে মোকাবিলা করতে গিয়ে পাকিস্তান তাঁর অখন্ডতা হারিয়ে ফেলে। ৫৪ সালের নির্বাচনের পর ৭০ সালের নির্বাচনেও অধিকতর শক্তি, গোছালো এবং পরিণত হয়ে উঠবে তা তাঁদের ধারণার বাইরে ছিল। তাঁর সাথে যোগ হয়েছিল জুলফিকার আলী ভূট্টোর অতিরিক্ত ক্ষমতালোভ ও কোন অবস্থাতেই বিরোধী দলে বসতে রাজী না হওয়া।

তবে এই নির্বাচনে সুক্ষèভাবেভাবে ৬ দফার আড়ালে স্বাধীনতার জন্য সুদূর গ্রামেগঞ্জে তরুণ ও যুবকদের মধ্যে স্বাধীনতার প্রস্তুতি ও জনসম্পৃক্ততার কাজ করে নিউক্লিয়াসের অনুসারীরা। স্বাধীনতার প্রতি দৃঢ় অঙ্গিকারবদ্ধ এই অংশটি বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ক্ষমতায় যাওয়ার শত প্রলোভন এবং ভয়ভীতিকে কাটিয়ে উঠতে প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে। মাঠে-ময়দানে আপোষবিরোধী ভূমিকা রাখার মাধ্যমে জনগণকে উজ্জীবিত করেছে। বাংলাদেশর স্বাধীনতাকে অনিবার্য করে তুলেছে।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে নবযাত্রা শুরু হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বর্হিপ্রকাশ ছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল তারই ধারাবাহিকতার চূড়ান্তরূপ। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক , সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের প্রতি যে আস্থা রেখেছিল, নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্য এবং ক্ষমতার প্রতি মোহ এই আস্থার প্রতিদান দিতে নেতারা ব্যর্থ হয়েছিলেন। জনগণের রায়ের পর যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে গিয়েছিল। পরস্পরের দোষারোপের মাধ্যমে জনগণের কাছে জবাবদিহি করেছিল। তাই ১৯৭০ সালে একক নেতৃত্ব এবং একক দলের প্রতি বাঙালির রায় নেতৃত্বকে আরো দায়িত্বশীল এবং জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসে।

পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জীবনাচারে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য যেমন ছিল, তেমনি ছিল ভিন্নতা। পাঞ্জাবের প্রধান শহর ছিল লাহোর। লাহোরকে কেন্দ্র করে যে মুসলিম অভিজাত শ্রেণি গড়ে উঠে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর তারাই পাকিস্তানের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, সামাজিক, সামরিক প্রশাসনিক কর্তৃত্বে চলে আসে। তার সাথে যোগ হয় মুম্বাই, দিল্লী, মাদ্রাজ এলাহাবাদ লৌক্ষè, মুর্শিদাবাদ কলকাতা থেকে আগত মুসলিম অভিজাত শ্রেণি, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। যাদের অধিকাংশই পাকিস্তানের নতুন রাজধানী করাচীকে কেন্দ্র করে নতুন আভিজাত শ্রেণি হিসেবে লাহোরের অভিজাতকে চ্যালেঞ্জ জানায়। পাকিস্তানের ক্ষমতা দ্বন্দ্বে বাঙালি হয়ে উঠে অন্যতম নির্ধারক শক্তি। কিন্তু আইউব খানের সামরিক শাসনের মাধ্যমে পাঞ্জাবী অভিজাত শ্রেণি একক ক্ষমতায় উঠে আসে। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলমাবাদে স্থানান্তরের মাধ্যমে এই একক ক্ষমতা আরো নিরঙ্কুশ হয়ে উঠে।

এর পূর্বে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান তৈরী করে পাঞ্জাব, বেলুচ, পাঠান ও সিন্ধিদের নিয়ে গঠিত প্রদেশসমূহকে নিয়ে এসে পশ্চিম পাকিস্তান সৃষ্টি করে। পাঞ্জাবীদের কর্তত্ব প্রতিষ্ঠা করে। পশ্চিম পাকিস্তানকে একটি প্রদেশ করে এবং পূর্ব বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তান নাম দিয়ে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে নতুন করে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। দুই পাকিস্তানের সমসংখ্যক জনপ্রতিনিধি নিয়ে আইন সভা ও ক্ষমতার ভারসম্যা রক্ষার চেষ্টা করা হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের অপাঞ্জাবীদের সাথে বাঙালির আঁতাত এবং করাচী অভিজাতদের ও লাহোর অভিজাত দ্বন্দ্বে বাঙালিদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং কর্তত্ব বাঙালিদের হাতে চলে আসবে, এটা কোন অবস্থায় মেনে নিতে পারছিল না। তাই ১৯৫৬ সালে সংবিধান গৃহীত হবার পর নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বে সামরিক শাসন জারি করে রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। সামরিক আইন জারি করে প্রধান সেনাপতি আইউব খান একক ক্ষমতা গ্রহণ করে পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনকে তাঁদের আজ্ঞাবহ করে তুলে। বৃটিশ আমলে বাংলাদেশ যে স্বাধীনতা ভোগ করতো তাও রহিত করা হয়। করাচী থেকে রাজধানী স্থানান্তর করে করাচীর অভিজাত শ্রেণিকেও পঙ্গু করে দেয়। সেই সাথে বাঙালিদের জন্য রাজধানীকে দুর্গম করে তোলে। কারণ করাচী স্বল্প খরচে হলেও জাহাজে করে পৌঁছানের ব্যবস্থা ছিল। করাচী থেকে ইসলামাবাদ পৌঁছা বাঙালির জন্য ছিল আরো দুরুহ। ইসলামাবাদে রাজধানী নিয়ে গিয়ে সেই সুবিধা থেকেও বঞ্চিত করে। আইউব খান, পাঞ্জাবী সামরিক ও বেসামরিক আমলারা চেয়েছে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকে বাঙালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে অতিক্রম করা। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা বাড়িয়ে বাঙালিদের মোকাবিলা করা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যদি বাঙালি ভুল করতো তাহলে এই ভুল সংশোধন কোন দিন পারতো কিনা সন্দেহ আছে। বর্তমানে ১৮ কোটি পাকিস্তানীদের সংখ্যা তাই প্রমাণ করে।

বাঙালি মুসলমানেরা হিন্দু জমিদার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এবং হিন্দু মধ্যবিত্তকে মোকাবিলা করার জন্য মুসলিম জাতীয়তাবাদকে আশ্রয় করে নিজেদের বিকশিত করার যে আশা ও আকাক্সক্ষাা নিয়ে পাকিস্তান আন্দোলন শরিক হয়েছিল এবং পাকিস্তান সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল, পাকিস্তানের সামরিক শাসনের মাধ্যমে একক রাজনৈতিক ক্ষমতার মাধ্যমে বাঙালি তার পূর্বেকার স্বাধীনতাও হারিয়ে বসে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে বাঙালি তাঁর হারানো ক্ষমতা ও স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের সুযোগ পেয়ে যায়।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৭০ সালের পূর্বে দীর্ঘ ২৩ বছরে পাকিস্তানের জনগণের সরাসরি ভোটে আর কোন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ৫৪ সালের নির্বাচন ছিল শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানে এবং শুধুমাত্র প্রাদেশিক পরিষদের জন্য। তাই ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল পাকিস্তানের জনগণের জনমত প্রতিফলনের প্রথম সুযোগ। শাসকদের সম্পর্কে তাঁদের মতামতের একটি সামষ্টিক চেতনা। এই চেতনা দ্বারা দুই দেশের জনগণ জানিয়ে দেয় তাঁদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক চাওয়া-পাওয়া দুই বিপরীত মেরুতে। সুতরাং গণতন্ত্র এবং নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিচালিত হলে বাঙালিদের কর্তৃত্ব মানতে হবে।

১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল পাকিস্তানের অখন্ডতা বজায় রাখতে হলে বাঙালিদের কর্তৃত্ব মেনে নেয়া, যা ছিল পাঞ্জাবীদের কর্তৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ। বাঙালিদের ছিল হয় পাকিস্তানের কর্তৃত্ব নতুবা পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের স্বাধীন হিসেবে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। পাঞ্জাবীরা পাকিস্তানের অখন্ডতার বিনিময়ে তাঁদের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে। বাঙালি তাঁর স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ইতিহাসে লেখা থাকবে বাঙালির আত্মত্যাগের মহিমা, বিজয়গাঁথা আর পাঞ্জাবীদের ইতিহাসে লেখা থাকবে বর্বরতম গণহত্যার পাশাপাশি পরাজয়ের গ্লানী। যে গ্লানী থেকে পাকিস্তান এখনও বেরিয়ে আসতে পারে নি। (সমাপ্ত)

নাওজিশ মাহমুদ রাজনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট