চট্টগ্রাম রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

মানব পাচার রোধে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে

সমকাল দর্পণ

ড. মাহফুজ পারভেজ

২৩ নভেম্বর, ২০১৯ | ৫:৩৯ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে মানব পাচারের হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাত কন্যা বা সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত ভারতের উত্তর-পূর্বের সাতটি রাজ্যে বিগত তিন বছরে (২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে) প্রায় ২৮ হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন।
ভারতের রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী এই তথ্য স্বীকার করেছেন। তাছাড়া ভারতের সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে মোট ২৭,৯৬৭ জন নিখোঁজ হওয়ার তথ্যও প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুসারে সবচেয়ে বেশি মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন আসাম রাজ্য থেকে, সংখ্যার হিসাবে তা ১৯৩৪৪ জন। তাছাড়া ত্রিপুরা থেকে ৪৪৫৫ জন, মেঘালয় থেকে ১৩৮৫ জন, মণিপুর থেকে ৯৯৯ জন, সিকিম থেকে ৯৭৪ জন, অরুণাচল থেকে ৪৫৭ জন, নাগাল্যান্ড এবং মিজোরাম থেকে যথাক্রমে ৩৪৩ এবং ১০ জন মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন।
মানব পাচারের সমস্যার পেছনে সংঘবদ্ধ অপরাধী গোষ্ঠীর ভূমিকা রয়েছে বলে ভারতের অনেকগুলো দায়িত্বশীল সূত্র এবং গবেষণা সংস্থা মনে করে। ‘নারী ও শিশু পাচার চক্র উত্তর- পূর্ব ভারতে অত্যন্ত সক্রিয়’ বলে রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে স্বীকারোক্তি করতে বাধ্য হয়েছেন খোদ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিষাণ রেড্ডি। তিনি জানিয়েছেন বিস্তারিত পরিসংখ্যানও।

মন্ত্রীর দেওয়া ভাষ্যানুযায়ী, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালের পুরো তথ্য এখনও সরকারের হাতে আসেনি। ২০১৫ সালে আসাম থেকে ২১৬৯ জন শিশু, ২৬১৩ জন মহিলা এবং ১৫২৮ জন পুরুষ নিখোঁজ হয়েছেন। ২০১৬ সালে ২৪১৩ জন শিশু, ৩৪৩৯ জন মহিলা এবং ২১৩০ জন পুরুষ নিখোঁজ হয়েছেন।
মন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, ২০১৭ সালে ১৬৫১ জন শিশু, ২৪৫৩ জন মহিলা এবং ৯৪৮ জন পুরুষ নিখোঁজ হয়েছেন। ত্রিপুরায় ২০১৫ সালে ১৭৯ জন শিশু, ৫৮৩ জন মহিলা এবং ৪০১ জন পুরুষ নিখোঁজ হয়েছেন। ২০১৭ সালে ১৬৬ জন শিশু, ৯৩৩ জন মহিলা এবং ৬৪২ জন পুরুষ নিখোঁজ হয়েছেন। মেঘালয় থেকে ২০১৫ সালে ১৭৯ জন শিশু, ১৩৮ জন মহিলা এবং ১২৬ জন পুরুষ নিখোঁজ হয়েছেন। ২০১৬ সালে ১৮৪ জন শিশু, ১৫৯ জন মহিলা এবং ১৫৫ জন পুরুষ নিখোঁজ হয়েছেন। ২০১৭ সালে ১৪৮ জন শিশু, ১৩৬ জন মহিলা এবং ১৬০ জন পুরুষ নিখোঁজ হয়েছেন। মনিপুর থেকে ২০১৫ সালে ৭০ জন শিশু, ৪৬ জন মহিলা এবং ৫২ জন পুরুষ নিখোঁজ হয়েছেন। ২০১৬ সালে ১৮৬ জন শিশু, ১৫৪ জন মহিলা এবং ১৫৪ জন পুরুষ নিখোঁজ হয়েছেন। ২০১৭ সালে ৯৭ জন শিশু, ১৩১ জন মহিলা এবং ১০৯ জন পুরুষ নিখোঁজ হয়েছেন। সিকিম থেকে ২০১৫ সালে ১১৯ জন শিশু, ৭৭ জন মহিলা এবং ৫৬ জন পুরুষ নিখোঁজ হয়েছেন। ২০১৬ সালে ১৫০ জন শিশু, ৬৬ জন মহিলা এবং ৩৭ জন পুরুষ নিখোঁজ হয়েছেন।
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৭ সালে ৮৮ জন শিশু, ২২৫ জন মহিলা এবং ১৫৬ জন পুরুষ নিখোঁজ হয়েছেন। অরুণাচল প্রদেশ থেকে ২০১৫ সালে ১০৫ জন শিশু, ৩২ জন মহিলা এবং ১৮ জন পুরুষ নিখোঁজ হয়েছেন। ২০১৬ সালে ৬১ জন শিশু, ৩৪ জন মহিলা এবং ১৩ জন পুরুষ নিখোঁজ হয়েছেন। ২০১৭ সালে ৭৪ জন শিশু, ১১২ জন মহিলা এবং ৮ জন পুরুষ নিখোঁজ হয়েছেন। নাগাল্যান্ড থেকে ২০১৫ সালে ৩৪ জন শিশু, ১৭ জন মহিলা এবং ১১ জন পুরুষ নিখোঁজ হয়েছেন। ২০১৬ সালে ৭৭ জন শিশু, ২০ জন মহিলা এবং ১৯ জন পুরুষ নিখোঁজ হয়েছেন। ২০১৭ সালে ১০৩ জন শিশু, ৪০ জন মহিলা এবং ২২ জন পুরুষ নিখোঁজ হয়েছেন।
পাশাপাশি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অপর একটি তথ্যও দিয়েছেন। উত্তর পূর্বের ৮ রাজ্য থেকে ২০১৫-১৭-র মধ্যে ৫১৩০ টি শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৩৭৬ টি শিশু আসামের, ৪৭২ জন ত্রিপুর, ৩৭৭ জন মেঘালয়ের, ২৭৭ জন মনিপুরের, ২৬৯ জন সিকিমের, ১৯২ জন নাগাল্যান্ডের, ১৬৩ জন অরুণাচল প্রদেশের এবং ৪ জন মিজোরামের।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মানব পাচার সমস্যাকে অন্যতম প্রধান বিপদ বলে মনে করা হচ্ছে। নারী ও শিশু পাচারের নেটওয়ার্ক দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ছড়িয়ে গেছে। ফলে সমস্যাটি রাষ্ট্রীয় সমস্যার গ-ি পেরিয়ে আন্তরাষ্ট্রীয় তথা আঞ্চলিক সমস্যা রূপে পরিগণিত হচ্ছে।
বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা ও থিঙ্কট্যাঙ্কের বরাতে জানা যাচ্ছে যে, দক্ষিণ এশিয়ায় মাদক, সন্ত্রাস, অস্ত্র চোরাচালানের পাশাপাশি মানব পাচার সমস্যাটিও ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব সমস্যা রাষ্ট্রীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি স্বরূপ, যা শান্তি, স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্য বিনষ্ট করছে। মানব পাচার সমস্যা নিয়ে কাজ করে, এমন কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিশেষজ্ঞদের মতে, পাচারকৃত মানবের মধ্যে নারী ও শিশুই বেশি। যাদেরকে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন কুখ্যাত পতিতালয়ে জোরপূর্বক দেহব্যবসায় লিপ্ত করা হয়। তাছাড়া যৌনাত্মক চলচ্চিত্র নির্মাণ, কঠিন শ্রমে বাধ্য করা ইত্যাদিতেও পাচারকৃতদের নিয়োজিত করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের মতে, টাকা দিয়ে বা প্রলোভন দেখিয়ে দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ সমাজ থেকে নারী ও শিশুদের নিয়ে পাচার করা হয়। কখনো চাকরির নামে নারী ও শিশুদের বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়, যারা আর কখনোই স্বগৃহে ফিরে আসে না।

মানব পাচারকে বর্তমানে তুলনা করা হয় আধুনিক ‘দাস ব্যবসা’ নামে। কোটি কোটি টাকায় হাজার হাজার নারী ও শিশুকে পাচার করে অবৈধভাবে দেশে-বিদেশে কেনা-বেচা করা হয়। নানা ধরনের যৌন নিপীড়ন ও শ্রমে নিয়োজিত করা ছাড়াও কখনো কখনো পাচারকৃতদের রক্ত, কিডনি, চক্ষু ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করা হয়। বর্তমান বিশ্বে অবৈধ ব্যবসার মধ্যে অস্ত্র, মাদক ও মানব পাচার টাকার অঙ্কে শীর্ষস্থানীয়।
দক্ষিণ এশিয়ায় মানব পাচার রোধে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ চলছে। তথাপি সমস্যাটি রোধ করা বা কমিয়ে আনা যাচ্ছেনা। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মানব পাচারের থাবা বিস্তারের তথ্য বরং এ সমস্যার বিস্তারের ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা সমস্যাটিকে সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করার প্রয়োজনীয়তাকেই তীব্রভাবে সামনে নিয়ে এসেছে।

ড. মাহফুজ পারভেজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ; প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট