চট্টগ্রাম বুধবার, ২২ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

বিশ^নবী’র (স.) শৈশবের কিছু অলৌকিক ঘটনা

কালান্তরে দৃষ্টিপাত

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী

৫ নভেম্বর, ২০১৯ | ২:৩০ পূর্বাহ্ণ

নবী পাক (স.)’র শানে মোবারক জীবনের উপর বিভিন্ন বিষয়ে বারে বারে পড়ে শিক্ষা লাভ করা আমাদের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। নিজেও মহান রবিউল আউয়াল মাসে নবী পাক (স.)’র শানে কলম ধরতে মন থেকে তাড়িত হই। নবী পাক (স.)’র শিশু ও বাল্যকালের কয়েকটি বিষয় পাঠক মহলে পেশ করলাম।

তদানীন্তন মক্কার সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত পরিবারসমূহের এই প্রথা প্রচলিত ছিল যে, তাদের নবজাত শিশুদিগকে দুগ্ধ পান ও লালন-পালনের জন্য উপযুক্ত সেবিকার হেফাজতে রাখা হত। নবী পাক (স.)কে জন্মের পর কিছু দিনের জন্য ছুওয়ায়রা নামীয় নবী পাক (স.)’র চাচা আবু লাহাবের জনৈকা ক্রীতদাসীর দুধ পান করান। বর্ণিত আছে যে, আবু লাহাব পরলোকগত ভাই আবদুল্লাহর পুত্রের জন্মগ্রহণে এইরূপ খুশি হয়েছিল যে, সে তার ক্রীতদাসকে মুক্ত করে দিয়েছিল। এই ক্রীতদাসী নবী পাক (স.)’র অপর এক চাচা হামযাকেও, যিনি নবী পাক (স.) প্রায় সমবয়সী ছিলেন, দুধ পান করিয়েছেন। কিছুদিন পর নবী পাক (স.)কে কুরাইশের হাওয়াযিন শাখার বানূ সা’দ গোত্রের হালিমা বিনতে আবু যু’আয়বের তত্ত্বাবধানে অর্পণ করা হয়। তারা হুদায়বিয়ার উম্মুক্ত ও স্বাস্থ্যকর সমভূমি এলাকায় বাস করতেন। নির্ভেজাল আরব সংস্কৃতি ও নিজেদের ভাষার উচ্চমানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। হযরত হালিমার বাড়ি ঘর তায়েফের অনতীদূরে কবে থেকে ছিল তা অষ্পষ্ট। হালিমার স্বামী ছিলেন আল-হারিছ ইবনে আবদুল উয্যা ইবন রিফা’আহ (সম্ভবত আবু কাবশাহ নামেও অভিহিত ছিলেন)। এই দম্পত্তির নিজেদের আবদুল্লাহ নামে একটি পুত্র সন্তান এবং উনায়সা ও হুযাফা নামে দুইটি কন্যা সন্তান ছিলেন। শেষোক্ত মেয়েটি সাধারণ্যে শায়মা নামে অধিকতর পরিচিত ছিলেন। তিনি ও তাঁর মাতা প্রধানত শিশু নবী পাক (স.)’র দেখাশুনা করতেন। নবী পাক (স.) তাঁর শেষ জীবনে শায়মা ও দুধ সর্ম্পকের অন্যান্য আত্নীয়দের প্রতি ¯েœহ ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিলেন।

নবী পাক (স.) প্রথম দুই বছর হালিমার তত্ত্বাবধানে লালন-পালনাধীনে ছিলেন। এই সময় হালিমা শিশু নবী পাক (স.) কে প্রতি ছয় মাস অন্তর আমিনার নিকট নিয়ে আসতেন বেড়ানোর জন্য। শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্য দেখে তার সন্তুষ্টির জন্য। প্রথম দুই বছর পূর্ণ হবার পর হালিমা শিশুকে আমিনার নিকট চূড়ান্তরূপে ফেরত প্রদানের উদ্দেশ্যে নিয়ে আসেন। কিন্তু হযরত আমিনা মক্কায় তৎকালীন অস্বাস্থ্যকর আবহাওয়া এবং শিশুর সন্তোষজনক বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যের কারণে তাঁকে আরও কিছুদিন হালিমার নিকট রাখবার জন্য অনুরোধ করেন। হালিমা শিশুকে ফেরত পেয়ে অতিশয় আনন্দিত হলেন। কারণ তিনি ইতিমধ্যে এই অসাধারণ স্বাস্থ্যবান সুদর্শন ও মধুর আচরণবিশিষ্ট বালকটির জন্য দৃঢ় মাতৃসুলভ ¯েœহ ও মমতা অনুভব করছিলেন। এই রূপে তিনি তাঁর দুধসর্ম্পকীয় পিতা-মাতার নিকট আরও দুই বছর বা অনুরূপ অবস্থান করেন।

দুধসর্ম্পকীয় পিতা-মাতার সঙ্গে তাঁর এই দ্বিতীয় মেয়াদের অবস্থানকালে তাঁর জীবনে এক অলৌকিক ও অতি প্রাকৃতিক ঘটনা সংঘটিত হয়। যা শাককুস সাদর বা বক্ষ বিদারণ নামে পরিচিত। ঘটনার বিস্তারিত বিষয় এবং তারিখ ও স্থান সর্ম্পকে বর্ণনাকারীগণ ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন।
আরবের রেওয়াজ ছিল সন্তান জন্মের পর কোন দাত্রীর কাছে লালন-পালন করতে দেয়া। সে মতে নবী পাক (স.) তায়েফের অনতি দূরে হযরত হালিমা (র.)’র ঘরে লালিত পালিত হন।

হযরত নবী পাক (স.)’র দুধ মা হালিমা বিনতে হারেস (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী পাক (স.)’র দুধ মা হালিমা বিনতে হারেস (র.) বলেন: আমি আমার স্বামী হারেস বিন আবদুল উয্যা এর সাথে মক্কা রওয়ানা হলাম। তখন দুর্ভিক্ষের সময় ছিল আমাদের সাথে পানাহারের জন্য কোন কিছু ছিল না। আমাদের সাথে আমাদের উট ছিল, আল্লাহর কসম! তা থেকে এক ফোটা দুধও আসত না, আমার সাথে আমার বাচ্চাও ছিল, সে ক্ষুধার কারণে এত কাঁদত যে, রাতে আমরা ঘুমাতে পারতাম না। আমার বুকেও দুধ ছিল না, না আমাদের উটে, যা থেকে আমি বাচ্চাকে দিব, তবে আমাদের কামনায় ছিল একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ। যখন আমরা (পবিত্র) মক্কায় পৌঁছলাম তখন আমাদের মধ্যে এমন কোন মহিলা ছিল না যার কাছে নবী পাক (স.) কে পেশ করা হয় নাই, কিন্তু সকলেই তাঁকে নিতে অস্বীকার করল। আমরা বাচ্চার পিতার নিকট তার সন্তানকে দুধ পান করানোর বিনিময়ে ভাল পারিশ্রমিক কামনা করতাম। নবী পাক (স.) এতিম ছিলেন, তাই আমরা মনে করতাম যে তাঁর মা আমাদেরকে কিইবা দিতে পারবে? আমি ব্যতীত আর কোন মহিলা ছিল না যে, কোন বাচ্চা দুধ পান করানোর জন্য পায় নাই, আর আমি পছন্দ করছিলামনা যে খালি হাতে ফেরত যাই, তাই আমি আমার স্বামীকে বললাম যে: আমি এ এতিম বাচ্চাটিকে বাড়িতে নিয়ে যাব এবং তাকে লালন পালন করব, তাই আমি এ বাচ্চাটিকে আমাদের কাফেলায় নিয়ে আসলাম, তখন আমার স্বামী বলল: নিয়ে এসেছ? আমি বললাম: হ্যাঁ নিয়ে এসেছি। আল্লাহর কসম এটা ব্যতীত আর কোন বাচ্চা নেই, স্বামী বলল: চল ভাল করেছ, হতে পারে আল্লাহ এতে আমাদেরকে উপকৃত করবেন, হালিমা বলেন: আল্লাহর কসম! যখনই আমি তাকে আমার কোলে তুলে নিলাম এবং তাঁর মুখে নিজের স্তন দিলাম, তখন তাতে এত দুধ আসল যে সে নিজেও তৃপ্তি সহকারে পান করল এবং তাঁর দুধ ভাইও (হালিমার আপন ছেলে)। রাতে আমার স্বামী উটের দুধ দোহন করতে উঠল, তখন দেখল উটের স্তন দুধে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। উট থেকে আমরা যথেষ্ট দুধ পেলাম, যা আমার স্বামী তৃপ্তি সহকারে পান করল, আমিও তৃপ্তি সহকারে পান করলাম। ঐ রাতে আমরা অত্যন্ত তৃপ্তি ও ভালভাবে যাপন করলাম, আমাদের বাচ্চাও আরামে ঘুমাল। বাচ্চার পিতা বলল: আল্লাহর কসম! হালিমা তুমি অত্যন্ত বরকতময় সন্তান পেয়েছ, আমাদের বাচ্চারও পেট ভরে গেছে আর সে আরামে ঘুমাচ্ছে, অন্য কেউ তার সাথে চলতে পারছিল না, এমনকি লোকেরা বলতে লাগল, আরে হারেসের মেয়ে আমাদের প্রতি একটু দয়া কর, এটাই কি ঐ উট যাতে আরোহণ করে তোমরা মক্কা এসেছিলে। আমি বলি হ্যাঁ, আল্লাহর কসম! ঐ উটই এবং আমাদের উট সকলের আগেই চলতে থাকল এমন কি আমরা এভাবেই সা’দ বিন বকর বংশে পৌঁছে গেলাম। আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভিক্ষময় এলাকায় এসে পৌঁছলাম, ঐ সত্ত্বার কসম যার হাতে হালিমার জীবন সকালে মানুষের বকরীর পাল চারণ ভূমিতে যেত। আমাদের বকরীও চারণ ভূমিতে নিয়ে যেতাম, আমার বকরী অত্যন্ত তৃপ্তি ও দুধে পরিপূর্ণ হয়ে ফিরে আসত, আর মানুষের বকরী ক্ষুধা এবং দুধ শূন্য হয়ে ফিরে আসত, আমরা যতটুকু দুধ চাইতাম ততটুকু পান করতাম, অথচ অন্যরা এক ফোঁটা দুধও পেত না, মানুষ তাদের রাখালদেরকে বলত: বোকার দল চড়াওনা যেখানে হালিমার রাখাল বকরী চড়ায়। তখন অন্যান্য রাখালরাও তাদের বকরী ঐ স্থানে চড়াতে লাগল যেখানে আমাদের রাখাল বকরী ক্ষুধা এবং দুধশূন্য হয়ে ফিরে আসে। আর আমাদের বকরী যথেষ্ট দুধে পরিপূর্ণ হয়ে ফিরে আসত। (আবু ইয়ালা তাবারানী)

হযরত আনাস বিন মালেক (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী পাক (স.)’র নিকট জিবরীল আসল, তখন তিনি বাচ্চাদের সাথে খেলাধূলা করছিলেন, জিবরীল তাঁকে ধরে শুয়ে দিল, বুক চিরে তাঁর হৃদপিন্ড বের করল, এরপর ওখান থেকে একটি মাংসের টুকরা বের করল এবং বলল: এ টুকরাটি তোমার মধ্যে শয়তানের ছিল, এরপর হৃদপিন্ডটি একটি পাত্রে রেখে জমজমের পানি দিয়ে ধৌত করল, এরপর তা যথা স্থানে রেখে তাঁর বুক শেলাই করে দিল, ইতিমধ্যে (অন্যান্য) বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করে তাঁর দুধ মা হালিমা সাদিয়ার নিকট আসল এবং বলল: নবী পাক (স.) কে হত্যা করা হয়েছে। লোকেরা দৌঁড়ে আসল এবং দেখল তিনি সুস্থই আছেন, তবে ভয়ে তাঁর শরীরের রং পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল, হযরত আনাস (র.) বলেন: আমি নবী পাক (স.)’র বুকে সেলাইয়ের দাগ দেখছিলাম। (মুসলিম)

হযরত আবু মুসা আল আশআরী (র.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আবু তালেব সিরিয়ার উদ্দেশে বের হলেন, তখন নবী পাক (স.) ও কুরাইশদের বয়োজৈষ্ঠদের সাথী হয়ে আবু তালেবের সাথে বের হলেন, যখন তাদের কাফেলা সিরিয়ার বাসরা নগরীর পাদ্রী তাদের বুহাইরার নিকট পৌঁছল তখন তারা তাদের সওয়ারীসমূহকে (বিশ্রামের জন্য) বসাল, ইতিমধ্যে পাদ্রী তাদের কাছে আসল যে ইতিপূর্বে আর কখনও তাদের নিকট আসে নাই। তখন কাফেলার লোকেরা তাদের সওয়ারী থেকে নিজেদের মালপত্র নামাচ্ছিল, পাদ্রী যেন কাউকে খুঁজছিল, সে নবী পাক (স.)’র নিকট এসে তাঁর হাত ধরে ফেলল এবং বলল: এটা সায়্যেদুল আলামীন,এটা রাব্বুল আলামীনের রাসূল,আল্লাহ তাঁকে রহমতুললিল আলামীন করে প্রেরণ করবেন। কুরাইশদের বয়োজৈষ্ঠরা পাদ্রীকে জিজ্ঞেস করল যে, তুমি তা কি করে বুঝতে পারলে? পাদ্রী উত্তরে বলল: যখন তোমরা এ উপত্যকা থেকে উঠছিলে তখন সমস্ত বৃক্ষ এবং পাথর তাঁর সম্মানে অবনত হচ্ছিল, আর এ সমস্ত বৃক্ষ এবং পাথর নবী ব্যতীত অন্য কারও নিকট অবনত হয় না। এতদ্ব্যতীত তাঁর কাঁধের হাড্ডির নিচে আপেলের ন্যায় নবুয়তের মোহর দেখেও আমি তাকে চিনেছি, এরপর ঐ পাদ্রী ফেরত গেল, কাফেলার লোকদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করল, পাদ্রী খাবার নিয়ে আসল। তখন নবী পাক (স.) উট চড়াতে ছিলেন, পাদ্রী বলল: তাঁকে ডাক, তিনি আসলেন তখন একটি মেঘ তাঁকে ছায়া করেছিল যখন তিনি লোকদের নিকটবর্তী হলেন তখন লোকদেরকে গাছের ছায়ার নিচে পেলেন, যখন তিনি ওখানে উপস্থিত হলেন তখন গাছের ছায়া তাঁর সম্মানে অবনত হল, পাদ্রী বলল: দেখ এ ছায়া তাঁর সম্মানে অবনত হয়ে আছে। এরপর পাদ্রী কাফেলার লোকেদেরকে বলল: আমি তোমাদেরকে আল্লাহর কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছি তোমরা আমাকে বল যে, তোমাদের মধ্যে এ বাচ্চার দায়িত্বশীল কে? কাফেলার লোকেরা বলল: আবু তালেব। পাদ্রী বার বার আল্লাহর কসম করে বলতে থাকল যে তাঁকে মক্কা পাঠিয়ে দাও, (যাতে করে শুত্রুরা তাঁকে হত্যা না করে ফেলে)। তখন আবু তালেব ওখানে থেকেই মক্কায় ফেরত পাঠালেন। (তিরমিযী)। নবী পাক (স.)’র শিশু ও বাল্যকালের ২/১টি বর্ণনা মহান রবিউল আউয়াল শানে পেশ করলাম।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট