চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

কোন পথে ছাত্ররাজনীতি?

প্রফেসর ড. মো. আবু তাহের

৪ নভেম্বর, ২০১৯ | ১:১৭ পূর্বাহ্ণ

বুয়েটের ছাত্র আবরারের নৃশংস হত্যাকা- এবং এর প্রেক্ষিতে বুয়েট প্রশাসনের গৃহীত পদক্ষেপ, ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকও বুদ্ধিজীবীদের অভিমত, সর্বোপরি সাধারণ মানুষ ও অভিভাবকদের উদ্বেগ-উৎকন্ঠা ইত্যাদি বিষয়ে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত অনেকগুলো প্রবন্ধ পড়া এবং টকশো দেখার সুযোগ হয়েছে। মূলতঃ এ ব্যাপারে আমার অভিব্যক্তি জানানোর জন্য আজকের প্রবন্ধের অবতারণা।

শুরুতেই ছাত্ররাজনীতি নিয়ে দু’একটা কথা বলতে চাই। ছাত্ররাজনীতি বলতে আমি বুঝি, ছাত্রদের কল্যাণ ও অধিকার সংরক্ষণের স্বার্থে সর্বোত্তম নীতিমালা ও কৌশলের প্রয়োগ সাধন। এ লক্ষ্যে ছাত্রসংসদ নির্বাচন নিয়মিত করণের মাধ্যমে ছাত্রসংসদকে কার্যকরী করা। উক্ত সংসদ ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে নিয়মিত সভা এবং তাদের মানবিক গুনাবলী বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষাসহায়ক বিভিন্ন কার্যক্রমে সহায়তা প্রদান করা; এমনকি ভবিষ্যতে যাঁরা রাজনীতিকে পেশা হিসেবে নেবেন, তাঁদের জন্য সময়ে সময়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।

বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এবং সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৭ পাকিস্তান আন্দোলন পর্বে মুসলিম ছাত্রলীগ, পাকিস্তান সময়ে ১৯৪৮ সালে পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগ, ১৯৫০ এর দশকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক কর্মকা-ের পাশাপাশি জাতীয় রাজনৈতিক বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। সেটাই হয়তো ছিল সময়ের দাবী। তখন রাজনীতিতে আদর্শ ও মূল্যবোধের চর্চা হতো এবং ছাত্রনেতৃবৃন্দ দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিত ছিল। তাঁদের লক্ষ্য মহৎ, স্বপ্ন ছিল বড় এবং এরই ফলাফল স্বাধীন ও স্বার্বভৌম বাংলাদেশ। অথচ বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির আচ্ছাদনেই যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের ছাত্রসংগঠনের নেতারা ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। পত্রিকান্তরে জানা গেল, স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি ক্যাম্পাসে প্রায় ১৫১টি লাশ পড়েছে। সন্ত্রাস, আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার, সিট দখল, টর্চার সেল, গণরুম ও গেস্টরুম সংস্কৃতি, নারীনির্যাতন ও ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন-পীড়ন ইত্যাদি ক্যাম্পাসের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যাম্পাসকে ঘিরে ছাত্রনেতাদের টেন্ডারবাজী, দখলদারিত্ব, দখলবাজী, চাঁদাবাজী, কমিশন বখরা, নেশা ও মাদক সেবন এমনকি হলগুলোতে সমান্তরাল প্রশাসন পরিচালনার কথাও শোনা যাচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে ছাত্ররাজনীতিতে ভীতশ্রদ্ধ হয়ে নব্বই দশকের সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ছাত্ররাজনীতি সম্পর্কে সবাইকে সজাগ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ তার কথায় কর্ণপাত করেনি। করলে ছাত্ররাজনীতির আজকের এ অধঃপতন হত না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যে ধারায় চলছে এমন অবস্থায় শুদ্ধ ও সুস্থ ধারার রাজনীতি ফিরে আসার সম্ভবনা ক্ষীণ। তবে উৎকন্ঠিত জাতি ছাত্ররাজনীতির বর্তমান অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চায়।

মূলতঃ একটি সমাজের অগ্রসরমান অংশ হিসেবে বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা দেশের ভালোমন্দ ভাববে এবং সে বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করবে। শিক্ষার্থীরা এ মতকে নিজের বিবেক ও যুক্তি বুদ্ধি অনুযায়ী গ্রহণ বা খন্ডন করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির নামে পেশীশক্তির দৌরাত্মা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ^বিদ্যালয়ে জ্ঞান চর্চার পরিবেশ যেমন বিঘিœত হচ্ছে তেমনি মুক্তচিন্তা ও বাকস্বাধীনতা ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সাধারাণ ছাত্র-ছাত্রীরা যেমনি রাজনীতিবিমুখ হচ্ছে তেমনি অভিভাবকেরা ভীতশ্রদ্ধ রয়েছে। তবে ভালো কাজের ডাক পেলে এবং নেতৃত্ব আকৃষ্ট হলে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা নির্দ্বিধায় সাড়া দেয়, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ সমসমায়িককালে ঘটে যাওয়া কয়েকটি সফল আন্দোলন। যেমন শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ, কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ইত্যাদি। ছাত্রদের এসব আন্দোলনে গণমানুষের ব্যাপক সমর্থন ছিল; এমনকি অনেকে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে।

স্বাধীনতাত্তোরকালে জাতীয় রাজনৈতিক দলের সাথে ছাত্রসংগঠনগুলোর সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে এটা সত্য, তবে সামরিকশাসক জেনারেল জিয়া ১৯৭৬ সালে রাজনৈতিক দল বিধি (চড়ষরঃরপধষ চধৎঃু জঁষবং,১৯৭৬) জারীর কারণে সব ছাত্রসংগঠন রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনে পরিণত হয়। এবং এরই ধারাবাহিকতায় ছাত্ররা রাজনৈতিক দলের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে কাজ করে। ছাত্ররাজনীতির নামে দলীয় লেজুড়বৃত্তিসহ ক্যাম্পাস দখলের যে অপসংস্কৃতি ও অপরাজনীতির চর্চা করেছে তা খুবই দুঃখজনক এবং কারো কাছেই তা কাম্য নয়।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করি, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নয়; বরং ছাত্রদের দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত। সাঠিক পর্যায়ে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে হবে। তাঁরা পাঠচক্র করবে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বশেষ অগ্রগতির বিভিন্ন দিক নিয়ে সভা-সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করবে বিতর্ক করবে, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চা করে অন্যায়-অনিয়মের প্রতিবাদ করবে, নাটক-সংগীত চলচ্চিত্র চিত্রকলার চর্চা করবে। বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেবে এবং শিক্ষকেরা অনুপ্রেরণ জোগাবে। বিশ^বিদ্যালয় শুধু ক্যারিয়ারিস্ট পেশাজীবী তৈরী করবে না; বরং সমাজ-দেশ সম্পর্কে সচেতন ও আলোকিত মানুষ হিসেবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলবে। এ লক্ষ্য নিয়ে বর্তমান ছাত্ররাজনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত।
এসব কথা অনেকের কাছে উচ্চাভিলাষী মনে হতে পারে; কিন্তু বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের এটাই একমাত্র পথ। এতে প্রতিটি বিশ^বিদ্যালয়ে বড় ধরনের সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সূচনা হবে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনকে আনন্দময় ও অনুসন্ধিৎসাময় করে তোলার জন্য কল্যাণকামী ছাত্ররাজনীতির প্রচলন করতে হবে। সেই রাজনীতির বীজ সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুপ্ত রয়েছে। প্রয়োজন সেই রাজনীতিকে বিকশিত করার জন্য যথাযথ ছাত্র নেতৃত্বের। আশা করি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতি সে পথে এগোবে, যা হৃত গৌরব ও ঐতিহ্য পুনরায় ফিরিয়ে আনতে অনেকটা সহায়ক হবে।
বর্তমান ছাত্ররাজনীতি কিছুটা পথভ্রষ্ট হয়েছে সত্য; তবে এখনো লক্ষ্যচ্যুত হয়নি। তাই রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সময়ক্ষেপণ না করে ছাত্ররাজনীতির বর্তমান কর্মকা-ের বাস্তবতা অনুধাবন করে যথাযথ করণীয় ঠিক করতে হবে। ভাবতে হবে যে উচ্চ শিক্ষার্থে যে সব মেধাবী শিক্ষার্থী বিশ^বিদ্যালয়ে পড়তে আসে, তাঁরা আমাদের সন্তান। এদের শিক্ষাজীবন নিরাপদ ও নিশ্চিত করা রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্বের মধ্যে বর্তায়।

এমতাবস্থায় সরকার ও দেশের সব দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল ছাত্ররাজনীতিকে শুদ্ধ ও সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে রাজনৈতিক স্বার্থ কিংবা দলীয় বিবেচনার উর্দ্ধে উঠে একটি ঐক্যমত্যে উপনীত হয়ে সম্ভাব্য করণীয়সমূহ নির্ধারণ ও এর যথাযথ বাস্তবায়ন করবেন, এটাই জাতির প্রত্যাশা।

ড. মো. আবু তাহের শিক্ষক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও সাবেক ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট