চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

যুগের কবি কাজী নজরুল ইসলাম

নাসের রহমান

২৬ আগস্ট, ২০২৪ | ১১:৫৪ পূর্বাহ্ণ

নজরুল আমাদের জাতীয় কবি। তিনি বহু কাল থেকে ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে বিদ্রোহী কবিতা লেখার পর তার পরিচয় হয় বিদ্রোহী কবি। পাঠ্যপুস্তকেও তার নামের আগে বিদ্রোহী কবি লেখা হয়। স্কুলের প্রতিটি ক্লাসে তার কবিতা পাঠ্য থাকে। প্রবন্ধ বা গল্পও কোন কোন ক্লাসে পাঠ্যসুচির অন্তভুক্ত হয়। ইন্টারমিডিয়েটেও তার লেখা পড়ানো হয়। দীর্ঘসময় ধরে নজরুল তরুণপ্রজন্মের কাছে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হতে থাকে। স্কুলে যা শিখানো হয় তা সহজে মনের ভেতর গেঁথে যায়। সময়ের ব্যবধানে তা স্থায়ী হয়ে যায়। সেটা আর সহজে সরানো যায় না। এজন্য নজরুলের বিদ্রোহী কবি পরিচয়টা কখনো জাতীয় কবির আড়ালে ঢাকা পড়ে না। যদিওবা জাতীয় কবির পরিচয়টা একটি বড় পরিচয়, অনেক মর্যাদারও।

 

অসাম্প্রদায়িকতা নজরুলের আরেকটি বড় পরিচিতি। সম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প কখনো নজরুলকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনিই প্রথম কবি, যিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবিতা লিখে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। নজরুল হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খৃস্টান সবাইকে একসূত্রে আবদ্ধ করতে চেয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম, হিন্দু মুসলমান’। সে সময়ের হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা নজরুলকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। এ সাম্প্রদায়িক হানাহানি বাঙালি জাতিকে বার বার অন্ধকারে নিমজ্জিত করছে। এ জাতিকে দাঁড়াতে হলে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তুলতে হবে। ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে হবে। তিনি বলেছেন, ধর্মের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্য ধর্ম। মানবধর্মকে নজরুল বড় করে দেখেছেন।

 

মানবতার কবি হিসেবে নজরুলকে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি সাম্যের গান গেয়েছেন। ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই, নহে কিছু মহিয়ান’। এজন্য তাকে সাম্যের কবি বলা হয়। তবে নজরুলের আগে সাম্যের কথা এত স্পষ্ট করে কেউ বলতে পারে নাই। তিনি মানুষকে সব কিছুর ঊর্দ্ধে স্থান দিয়েছেন। এতো স্বগর্ব উচ্চারণ আর কোথায় পাওয়া যায় না। দুঃখ, দরিদ্রতা, গ্লানি কোন কিছু নজরুলকে চিন্তাচেতনা থেকে বিচ্যুত করতে পারে নাই। তিনি আজীবন মানুষের জয়গান গেয়েছেন। মানবতার মাঝে মানুষের কল্যাণের সুর খুঁজেছেন। মানুষকে মানুষ রূপে দেখতে চেয়েছেন। সাধারণের মাঝে তিনি অসাধারণকে দেখতে পেয়েছেন।

 

কাজী নজরুল বাঙালীর রেঁনেসার কবি। জাগরণের কবি, চেতনার কবি। ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে নজরুলের অবদান সবচেয়ে বেশি। কবিতায় গানে নজরুল জাতিকে যেভাবে জাগিয়ে তুলেছেন তা আর কেউ পারেনি। তিনি শিকল ভাঙার গান গেয়েছেন। অন্যায় অত্যাচারের বিরদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। সমাজের কুসংস্কারকে পদদলিত করেছেন। এসবের বিরুদ্ধে নজরুল বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। বিদ্রোহ ঘোষণা করে তিনি ক্ষান্ত হননি। ভেঙে চুরে সব চুরমার করে জাগিয়ে তোলার পথ দেখিয়েছেন। ‘বিদ্রোহী আমি রণক্লান্ত, আমি সেইদিন হব শান্ত’। আসলে তিনি কখনো শান্ত হতে পারেননি। রণক্লান্ত হলেও নজরুল জাগরনের বাঁশি বাজিয়ে সবাইকে জাগিয়ে তুলেছেন। তার গান ও কবিতা বাঙালীর চেতনায় নব জাগরনের জোয়ার নিয়ে আসে। বাঙালীর সংস্কৃতিতে তার গান নতুন ধারার সংযোজন করে।

 

কাজী নজরুল ইসলাম তারুণ্যের কবি। তরুণদের তিনি সবসময় উজ্জিবিত করতে চেয়েছেন। কবিতা, গান ও প্রবন্ধে তিনি তরুণদের প্রেরণা যুগিয়েছেন, পথ দেখিয়েছেন। তার লেখা কবিতা সংকল্প ‘থাকব নাক বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে’। কিশোরদের কিভাবে অনুপ্রাণিত করে। কিশোরের মনে কি অদম্য ইচ্ছা জাগায়। ‘তরুণের অভিযান’ প্রবন্ধটিতে নজরুল তরুণ কারা, তরুণেরা কি করতে পারে, তারুণ্য কি এসব তুলে ধরেছেন। এটি কিশোরদের পাঠ্য হলেও সব বয়সের মানুষের কাছে তারুণ্যের উৎস হয়ে আছে। তরুণদের কোন বয়সসীমা নেই। যার মাঝে তারুণ্য আছে সেই তরুণ। সকল বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে সেই এগিয়ে চলতে পারে। তারুণ্যের শক্তিকে তিনি অনেক বড় করে দেখেছেন।

 

কবি নজরুল আজীবন যৌবনের গান গেয়েছেন। তিনি যৌবনের জয়গান গেয়ে মানুষদের উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন। ‘যৌবনের গান’ প্রবন্ধটি আসলে তার বক্তৃতা। এটি পাঠ্যবইয়ে সংকলিত হওয়ায় তরুণশিক্ষার্থীদের পড়ার সুযোগ হয়। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তৃতা দিতেন, গান গাইতেন। যৌবনের গান, জাগরনের গান, সাম্যের গান। মানুষ অধীর আগ্রহে তার গান শোনার জন্য অপেক্ষায় থাকতো। তিনি অল্পবয়সে মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। কখনো পালাগানের কবি, কখনো কবিতার কবি, আবার কখনো গানের কবি। কবি নজরুলের মতো এত বেশি জনপ্রিয় আর কেউ হয়ে উঠতে পারেনি। তার সমসাময়িক কেউ তারমতো এতো অধিক গান রচনা করতে পারেনি। তিনি যৌবনে সবার কাছে একজন কিংবদন্তী হয়ে উঠেন। শিল্প সাহিত্য ও সংগীতে তার মতো জনপ্রিয়তা আর কেউ অর্জন করতে পারেনি। তাই তিনি নিজেও বলেছেন, ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবুও আমারে দেব না ভুলিতে’।

 

সাধারণ মানুষের অপূর্ব ভালবাসায় নজরুল সিক্ত হলেও ব্যক্তিজীবনে তার অনেক অপূর্ণতা থেকে যায়। চিরকালই তিনি প্রেম ভালোবাসার পূজারী ছিলেন। অনেকে তাকে প্রমের কবি, ভালবাসার কবি বলে থাকে। তিনি বলেছেন, আমি প্রেম দিতে এসেছি, মানুষকে ভালবাসতে এসেছি। তার অনেক গানের মধ্যদিয়ে এ প্রেম ভালবাসা চিরয়াত রূপ লাভ করেছে। ‘আমায় নহে গো, ভালবাস মোর গান’। তার অসংখ্য গানে তিনি মানব-মানবীর মনের আকুতিকে, বিরহ বেদনাকে উপজীব্য করে বানী রূপ দিয়েছেন। এ গানগুলো মানুষের মনকে নানাভাবে দোলা দেয়, আন্দোলিত করে, প্রাণকেও অনুরণিত করে তোলে। সুন্দরের প্রতি তার বিশেষ অনুরাগ ছিল। তিনি গেয়েছেন, ‘তুমি সুন্দর তাই আমি চেয়ে থাকি, সে কি মোর অপরাধ’। অসুন্দরকে পেছনে ফেলে তিনি সবসময় সুন্দরকে ধরতে চেয়েছেন। মনের সৌন্দর্যকে খুঁজে বেড়িয়েছেন।
প্রকৃতির সাথে নজরুলের সম্পর্ক যেন অবিচ্ছেদ্য। প্রকৃতিকে তিনি নানাভাবে দেখেছেন। প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন। তার গান কবিতায় প্রকৃতি যেন অপূর্ব এক অনুসঙ্গ। প্রকৃতির ছোয়ায় তার অসংখ্য গানের বানী প্রকৃতির মতো বিমূর্ত হয়ে ওঠে। ফুল পাখি আর লতাপাতা তার গানকে বৈচিত্রময় করে তুলেছে। নৈসর্গিকতার অপরূপ সৌন্দর্যকে তিনি গানের অবয়বে অপূর্বরূপে তুলে এনেছেন। এসব গান যে কোন শ্রোতাকে মুগ্ধ করে তোলে, প্রকৃতির কাছে নিয়ে যায়। এজন্য কেউ কেউ তাকে প্রকৃতির কবিও বলে থাকে। আসলে নজরুল একজন স্বভাব কবি। তিনি যা রচনা করেছেন তা কবিতা হয়ে ওঠেছে, গান হয়ে ওঠেছে। তার কবিতা মানুষকে যেভাবে আলোড়িত করেছে, গানও মানুষের মনকে সেভাবে অনুরণিত করে তোলেছে।

 

গাছগাছালি লতাপাতার ভেতর ছোট্ট কাঠবিড়ালি বিচরণ করে। অস্থির চঞ্চল এ কাঠবিড়ালিকে নিয়ে এক অপূর্ব সুন্দর কবিতা লিখেছেন নজরুল। ‘খুকি ও কাঠবিড়ালি’ কবিতায় কাঠবিড়ালির সাথে ছোট্ট খুকির আলাপচারিতাকে তিনি কাব্যিক রূপ দিয়ে শিশুর মনোজগতকে তুলে ধরেছেন। প্রাণীর সাথে এধরনের কথোপাকথন আগে কেউ ভাবেনি। ‘ভোর হল দোর খোল, খুকুমনি উঠরে’ এরকম শিশুতোষ কবিতা আরেকটা পাওয়া যায় না। ‘লিচু চোর’ কবিতায় তিনি কিশোর মনকে কিভাবে ছুঁয়ে গিয়েছেন। ‘খোকার সাধ’ কবিতায় খোকা মাকে বলছে, ‘আলসে মেয়ে ঘুমিয়ে তুমি থাক, আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে’। এ সকাল শুধু সূর্য ওঠার সকাল নয়, নতুন দিনের সকাল, জেগে ওঠার সকাল। নজরুল যে সত্যিকার অর্থে একজন জাগরনের কবি তার স্বাক্ষর তিনি সর্বত্র রেখে গেছেন।

 

যুগের পর যুগ নজরুলের বহুমাত্রিক সৃষ্টি কর্ম জাতিকে প্রেরণা যুগিয়েছে। অন্ধকারে নিমজ্জিত জাতিকে আলোর পথের সন্ধান দিয়েছে। শতবর্ষ পূর্বে রচিত তার গান ও কবিতা এখনো আলোর দিশারী হয়ে শক্তি ও সাহসিকতার পথ দেখায়। নির্ভীক চিত্তে তিনি যে জাগরনের গান গেয়েছেন এখনো তরুণদের কণ্ঠে সেই গান ধ্বনিত হয়। তরুণেরা নতুন করে উজ্জীবিত হয়। অগ্নিবীনা আর বিষের বাঁশি যেন একই সুরে গাঁথা। যুগে যুগে কালে কালে নতুনভাবে আবর্তিত হতে থাকে। এজন্য কাজী নজরুল ইসলাম সর্বকালের কবি, সর্বযুগের কবি। যুগে যুগে তিনি আসবেন।

নাসের রহমান কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংকনির্বাহী।

পূর্বকোণ/এসএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট