চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

ভূমিসেবায় ভোগান্তি আর কত দিন

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৫:৪৫ অপরাহ্ণ

‘মেয়ের চিকিৎসার জন্য জায়গা বিক্রির সব প্রক্রিয়া শেষ করেন বোয়ালখালী পৌর এলাকার এক বাসিন্দা। জরুরি টাকার প্রয়োজনে তাড়াহুড়া করে জায়গা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে দর-দামও ঠিক হয়। কিন্তু বাদ সেধেছে খাজনা নিয়ে। ভূমি অফিসের এপস বন্ধ থাকায় খাজনা দিতে পারছেন না তিনি। খাজনা ছাড়া জায়গা রেজিস্ট্রি করা হয় না। চরম দুর্ভোগে পড়েছেন তিনি।
শুধু বোয়ালখালীর ওই ব্যক্তি নন, আরো অনেকেই এই দুর্ভোগে পড়েছেন। গত ২৬ নভেম্বর থেকে ভূমি পরিষেবা এপস বন্ধ রয়েছে। সংস্কার ও উন্নয়নের পর এপস চালু হলেও ধীরগতির কারণে কাজ করা যাচ্ছে না। এতে হাজার হাজার মানুষ অবর্ণনীয় ভোগান্তিতে পড়েছেন।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন ভূমি অফিস ঘুরে দেখা যায়, উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসগুলোতে ভূমিসেবা নিতে প্রতিদিন শত শত মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন। কিন্তু ভূমি পরিষেবা এপস কাজ না করায় ঘুরেফিরে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন সেবাগ্রহীতারা। কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেও কোনো সুরাহা না পেয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন তারা।
গত ২৫ নভেম্বর এ বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ভূমি মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, ভূমি ব্যবস্থাপনা অটোমেশন প্রকল্পের ভূমিসেবা মানোন্নিত (২য় সংস্করণ) চারটি সফটওয়্যার (মিউটেশন সিস্টেম, ভূমি উন্নয়ন কর সিস্টেম, ডিজিটাল রেকর্ড ও ম্যাপ ব্যবস্থাপনা সিস্টেম, ভূমি প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা সিস্টেম) এবং নব-সৃষ্ট একটি সফটওয়্যার (ল্যান্ড সার্ভিস গেটওয়ে) দেশব্যাপী প্রচলন ও ব্যবহারের প্রাথমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গত ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টা থেকে ১ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত অনলাইনে প্রচলিত তিনটি ভূমিসেবা (ই-মিউটেশন সিস্টেম, ই-পর্চা সিস্টেম এবং ভূমি উন্নয়ন কর সিস্টেম) বন্ধ থাকবে। গতকাল পর্যন্ত ভূমি পরিষেবা এপস কাজ না করায় জনভোগান্তি লেগে রয়েছে।
বোয়ালখালী সংবাদদাতা পূজন সেন জানান, ভূমিসেবা সার্ভারে জমির নামজারি আবেদন, খাজনা প্রদানসহ যাবতীয় কার্যক্রম প্রায় বন্ধ রয়েছে। এরফলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন ভূমিসেবাগ্রহীতারা। ভূমি কর্মকর্তারা জানান, সার্ভার খুললেও কোনো ধরনের কাজ করা যাচ্ছে না।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘বোয়ালখালীতে দিনে ৫০-৬০টি নামজারি আবেদন পড়তো। এখন তা শূন্যের কোঠায়। নতুন যে সিস্টেম সার্ভারে সংযুক্ত হয়েছে, সেই বিষয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ নেই। ফলে সেবা প্রদানে স্থবিরতা নেমে এসেছে।’ জসিম উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি জানান, ১৫ দিন আগে নামজারির আবেদন করেছিলেন। কিন্তু ভূমিসেবা সার্ভার বন্ধ থাকায় খাজনা দিতে পারেননি। ফলে নামজারি ফাইল আটকে রয়েছে।
ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. খোরশেদ আলম বলেন, গোমদÐী ইউনিয়ন ভূমি অফিসে দিনে প্রায় ২৩ হাজার টাকা খাজনা আদায় হতো। গত ২৬ নভেম্বর ভূমিসেবা সার্ভার বন্ধ হওয়ার পর থেকে খাজনা আদায় করা যাচ্ছে না।
খাজনা প্রদানের দাখিলা ও নামজারি খতিয়ান ছাড়া জায়গা-জমির দলিল রেজিস্ট্রি হয় না বলে জানান দলিল লেখক এসএম রবিউল হোসেন।
বোয়ালখালী সাব-রেজিস্ট্রি অফিস সূত্র জানায়, সপ্তাহে তিন দিন করে জমি রেজিস্ট্রি হয়। এতে বছরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার দলিল রেজিস্ট্রি হয়। গড়ে দিনে ২৪ থেকে ২৫টি দলিল রেজিস্ট্রি হয়। এখন তা ১-২ টিতে নেমে এসেছে। এতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
পটিয়া সংবাদদাতা রবিউল আলম ছোটন জানান, ভূমিসেবা প্রায় বন্ধ থাকায় কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না সেবাগ্রহীতারা।
পটিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্লাবন কুমার বিশ^াস জানান, সৃষ্ট সফটওয়্যার ৫টির নির্ধারিত স্পেসে (স্থানে) সমন্বিতভাবে স্থানান্তর, সমন্বয় এবং তথ্যের সাথে সংযোগ ও কার্যকারিতা সৃষ্টি করতে কাজ চলমান রয়েছে। তবে কবে নাগাদ সফটওয়্যারগুলো জনগণ ও অফিস সংশ্লিষ্ট ব্যবহারকারীরা স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করতে পারবেন তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কাক্সিক্ষত সেবা পাওয়ার জন্য সেবাপ্রার্থীদের ধৈর্য্য ধারণ করার অনুরোধ জানান এই কর্মকর্তা।
সরজমিনে দেখা গেছে, অনলাইনে নামজারির জন্য আবেদনকারী ও ভূমি উন্নয়ন কর প্রদানের জন্য বেশ কয়েকজন সেবাপ্রত্যাশী ভূমি অফিসে এলেও ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা সার্ভার জটিলতার কারণে তাদের সেবা দিতে পারেননি।
উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নের মুকুটনাইট গ্রাম থেকে আসা দিপু বড়–য়া নামের এক নারী সেবাপ্রার্থী জানান, তার পিতা ধনু শংকর বড়ুয়া ৭-৮ বছর আগে গ্রামের ৯ শতক জমি বিক্রি করেছেন। সম্প্রতি এই জায়গা রেজিস্ট্রি প্রদানের জন্য নামজারি আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু কয়েকবার ভূমি অফিসে আসলেও সার্ভার জটিলতার কারণে নামজারির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেননি। এদিকে বাবার শারীরিক অবস্থাও ভালো নয়।
রাউজান সংবাদদাতা জাহেদুল আলম জানান, সেবা বন্ধ থাকায় ভোগান্তি পোহাচ্ছেন উপজেলার শত শত ভূমি মালিক। প্রতিদিন উপজেলা ভূমি অফিস, ইউনিয়ন ভূমি অফিস ও স্থানীয় কম্পিউটার সেন্টারে ধর্ণা দিয়ে ডিজিটাল সেবা বঞ্চিত হয়ে ফিরে যাচ্ছেন সেবাপ্রার্থীরা।
পূর্ব গুজরার বাসিন্দা আবদুল মোতালেব নামের এক ভূমি মালিক বলেন ‘আমি বেশকিছু দিন থেকে ভূমি খাজনা দিতে এপস্রে মাধ্যমে আবেদন করতে চাচ্ছি। কিন্তু বার বার কম্পিউটার সেন্টারে গিয়ে ফিরে এসেছি।’
রাউজান উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রিদুয়ানুল ইসলাম বলেন ‘ভূমি এপস্ পুরোপুরি বন্ধ নয়। শনিবার থেকে বিভিন্ন আবেদন করা যাচ্ছে। অবশ্য ¯েøা কাজ চলছে।’
হাটহাজারী সংবাদদাতা খোরশেদ আলম শিমুল জানান, ভূমিসেবা বন্ধ থাকায় খাজনা ও নামজারি করাতে পারছে না মানুষ। এতে করে জমি বিক্রি হচ্ছে না। হাটহাজারী পৌর সদরে খাজনা দিতে আসা রাশেদ জানান, গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন ভূমি অফিসে খাজনা দিতে আসলেও দিতে পারিনি। এতে টাকার প্রয়োজন হলেও জমি বিক্রি করতে পারছি না।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) লুৎফুর নাহার শারমিন জানান, ‘এপস আপডেট করার কারণে সাধারণ মানুষ সেবা বঞ্চিত হচ্ছে।’
সাতকানিয়া সংবাদদাতা ইকবাল মুন্না জানান, জমি বিক্রির জন্য খাজনা পরিশোধ করতে কয়েকবার ইউনিয়ন ভূমি অফিস এসেছেন সোনাকানিয়ার সাইফুল ইসলাম। খাজনা পরিশোধ করতে না পারায় জমি বিক্রি করতে পারছেন না।
উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারিস্তা করিম বলেন, ‘দেশব্যাপী অনলাইনে ভূমিসেবা বন্ধ রয়েছে। অনলাইন ভূমিসেবা দ্রæত চালু হচ্ছে বলে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে।’
গত ১১ ডিসেম্বর আরেকটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে ভূমি মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছে, হয়রানিমুক্ত ও দুর্নীতিমুক্ত ভূমিসেবা সহজীকরণের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয় একটি নতুন সফটওয়ার ও চারটি সফটওয়্যার দ্বিতীয় ভার্সন উদ্বোধন করা হয়। এই মুহূর্তে সিস্টেমগুলো ধীরগতিতে চলছে। এছাড়াও কিছু কারিগরি জটিলতা ও ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। এতে সেবা পেতে অসুবিধা হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়।

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট