সম্প্রতি অতিবৃষ্টি ও প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে আসা উজানের পানিতে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল। বন্যায় প্লাবিত হয়েছে চট্টগ্রামের মীরসরাই, ফটিকছড়ি, হাটহাজারীসহ অন্তত ৭ উপজেলা। এসব উপজেলায় ঘরবাড়ি-দোকানপাটসহ নানা স্থাপনার পাশাপাশি বন্যার পানিতে ভেসে গেছে গবাদি পশু-পাখির বেশ কিছু খামার। এতে হাজার হাজার গবাদি পশু-পাখির মৃত্যু ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাড়ে তিনশ’র বেশি খামার। নষ্ট হয়েছে খামারে থাকা দানাদার খাবার, খড়-ঘাস, দুধ ও ডিম।
জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসেব অনুযায়ী, চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক বন্যায় পোল্ট্রি ও ডেইরিখাতে ৭ উপজেলায় সব মিলিয়ে ২০ কোটি ৯৭ লাখ ২৬ হাজার ২০০ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৭ কোটি ৮৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে মীরসরাইয়ে। সবচেয়ে কম ১১ লাখ ৬৯ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে সীতাকুণ্ডে। এর বাইরে ফটিকছড়িতে এক কোটি ৬৩ লাখ ৮৫ হাজার ২০০, হাটহাজারীতে ২৬ লাখ ৫৭ হাজার, রাউজানে ৩৭ লাখ সাত হাজার ৮০০, রাঙ্গুনিয়ায় ৪৯ লাখ ৬০ হাজার ২০০ এবং পটিয়ায় ২১ লাখ ৪৮ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
এসব উপজেলায় গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, মুরগি ও হাঁস মিলিয়ে ৩ লাখ ২৪ হাজার ২০৪ টি প্রাণি মারা গেছে বন্যায়। মৃত পশুপাখির আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১৪ কোটি ৬১ লাখ ৬৫ হাজার ২০০ টাকা। বন্যায় গবাদি পশুর ২৩২ টি এবং হাঁস-মুরগির ১২৪ টি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে অন্তত ৩ কোটি ৫২ লাখ ৮০ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এর বাইরে পশুপাখির ৫২ দশমিক ৭ টন দানাদার খাবার, ২০৭ দশমিক ৩ টন খড় এবং ৭২৪ দশমিক ২ টন ঘাস নষ্ট হয়েছে। এতে অন্তত এক কোটি ৩৫ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে খামারিদের। তবে কেবল পোল্ট্রি খাতেই ২৫ কোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি বৃহত্তর চট্টগ্রাম পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের। সংগঠনটির সভাপতি রিটন প্রসাদ চৌধুরী বলেন, বন্যায় চট্টগ্রাম জেলায় পোল্ট্রি খাতে অন্তত ২৫ কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শত শত খামারি সর্বস্ব হারিয়ে রীতিমত নিঃস্ব হয়ে গেছে।
এদিকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে ৭৬ কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হলেও কোনো ধরনের পুনর্বাসন বা প্রণোদনার আওতায় আসেনি খামারিরা। এতে ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না অনেক ঋণগ্রস্ত প্রান্তিক খামারি। ফটিকছড়ি উপজেলার দাঁতমারা ইউনিয়নের কাছিমার খিল এলাকার খামারি জমির উদ্দিন জানান, কয়েকমাস আগে ঋণ নিয়ে ব্রয়লার মুরগির খামার শুরু করেছিলেন। বন্যায় দুই হাজার মুরগির মৃত্যুসহ খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে পাঁচ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন তিনি। বন্যা পরবর্তী সময়ে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি তিনি, বরং পুরনো ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা থেকে নতুন করে ঋণ নিতে হয়েছে। পাশাপাশি নিজের একটি গরু ও স্ত্রীর গহনা বিক্রিও করতে হয়েছে তাকে। কোনো ধরনের সরকারি প্রণোদনা বা নগদ অর্থ সহায়তা পেলে সহজে ঘুরে দাঁড়ানো যেত বলে দাবি তার।
একই অবস্থা ডেইরি খামারিদেরও। মীরসরাইয়ের হিঙ্গুলি এলাকার ডেইরি খামারি আব্দুল মোতালেব জানান, বন্যায় তার খামারের ১২ টি গরু মারা গেছে। বেশ কিছু খাবারও নষ্ট হয়েছে। এতে ১০ লাখ টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তার। ঘুরে দাঁড়াতে সরকারি সহায়তা চান তিনি। বৃহত্তর চট্টগ্রাম পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের সভাপতি রিটন প্রসাদ চৌধুরী বলেন, নানামুখী চাপে প্রান্তিক খামারিরা এমনিতেই নিঃস্ব। যে কয়জন ছিল তাদের মধ্যে অর্ধ সহস্রাধিক একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাদের পুনর্বাসন করা না হলে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের পুনর্বাসনের বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো সহায়তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে বিশ^ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের মাঝে ৭৫ কেজি করে দানাদার খাবার বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি, এখনও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
পূর্বকোণ/ইব