চট্টগ্রাম বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫

সর্বশেষ:

পূর্বকোণের সঙ্গে একান্ত আলাপে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক

নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তরুণদের প্রতিনিধিত্বে দিশা পাবে দেশ

আরাফাত বিন হাসান

১০ আগস্ট, ২০২৪ | ১১:৫৫ পূর্বাহ্ণ

অল্প কয়েকদিনেই সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সঠিক বাজার মনিটরিং, চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট রুখে দিয়ে দেশের তরুণ শিক্ষার্থীরা তাদের সক্ষমতার জানান দিয়েছে। নতুন বাংলাদেশের নতুন কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনায় এই তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো গেলে সঠিক দিশা পাবে বাংলাদেশ। আর সবার অংশগ্রহণে সত্যিকারের বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ গড়া গেলেই উন্নয়ন আর পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ সুফল পাবে সাধারণ মানুষ।

দৈনিক পূর্বকোণ স্টুডিওতে আয়োজিত ‘একান্ত আলাপে’ এসব কথা বলেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক।

এদের মধ্যে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক রিজাউর রহমান, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সমন্বয়ক আবরার আল ফয়সাল সিয়াম, চট্টগ্রাম কলেজের সমন্বয়ক ইফফাত ফাইরুজ ইফা ও তানভীর শরীফ, চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের সমন্বয়ক শাহারিয়ার শিকদার এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত শিক্ষার্থীদের খাবার সরবরাহকারী তানভীর আলম রনি। পূর্বকোণ পাঠকদের জন্য সেই আড্ডার চুম্বকাংশ তুলে ধরা হলো প্রশ্নোত্তর আকারে।

প্রশ্ন: শিক্ষার্থীদের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাই-

রিজাউর রহমান: সরকার পতনের পরদিন শিক্ষার্থীদের একটি গ্রুপ ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় নেমে যায়। সেই ভিডিও দেখে চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীরাও সড়কে নেমে যায়। মূলত এটাই ছিল শুরুর দিকের অবস্থা। আমাদের দুটা স্লোগান ছিল। একটা হচ্ছে ‘তুমি কে, আমি কে- সমন্বয়ক, সমন্বয়ক।’ আরেকটা হচ্ছে ‘তুমি কে, আমি কে- বিকল্প, বিকল্প।’ সমন্বয়কদের গুম করায় আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ার একটা শংকা তৈরি হয়েছিল। এজন্য বলেছি, আমরা সবাই সমন্বয়ক। এরপর যখন শাসক দল বলেছিল তারা চলে গেলে বিকল্প কে? তখন বলেছি- আমরা সবাই বিকল্প। ওই চিন্তা থেকেই এখন পর্যন্ত বিকল্প হিসেবে জনবান্ধব বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছি।

প্রশ্ন: এই কাজের সমন্বয় কীভাবে করছেন?

রিজাউর রহমান: ২০১৮ সালে আমরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করেছিলাম, ওই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের একটা অভিজ্ঞতা তৈরি হয়েছিল। তখন আমরা পুরো বাংলাদেশকে দেখিয়ে দিয়েছিলাম কিভাবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সেই অভিজ্ঞতা এই ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কাজে আরও পূর্ণতা পেয়েছে। এ কারণেই মূলত আমাদের কাজ আপনাদের কাছে গোছালো মনে হচ্ছে। কিন্তু আমরা কেন্দ্রিয়ভাবে কোথাও সমন্বয় করছি না।

প্রশ্ন: শিক্ষার্থীরা ট্রাফিক সংশ্লিষ্ট আইন কীভাবে রপ্ত করল?

শাহরিয়ার সিকদার: তাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। এখন পর্যন্ত তাদের বয়স, তারা চারপাশ থেকে যা শিখছে সে জ্ঞান থেকেই এটা প্রয়োগ করছে।

প্রশ্ন: আপনারা আর কী কী কার্যক্রম পরিচালনা করছেন?
রিজাউর রহমান: এই মুহূর্তে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, আর্ট বা গ্রাফিতি, দেয়াল পরিষ্কার করা, বাজার মনিটরিং, সিন্ডিকেট ভাঙা ও চাঁদাবাজি বন্ধে কাজ করছি আমরা। সব মিলিয়ে আমরা রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ করছি ।

প্রশ্ন: কোনো সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন?

তানভীর শরীফ: অনেকেই শিক্ষার্থীদের কথা শুনতে চান না, একটু বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করে। তখন আমরা তাদের বুঝিয়ে আইনের বিষয়ে জানানোর চেষ্টা করি। এর বাইরেও শুরুর দিকে খাবারসহ আরও কিছু সমস্যা ছিল। আমাদের উদ্যোগে খুশি হয়ে এখন অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। এখন আর তেমন কোনো সমস্যা নেই।

প্রশ্ন: রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে মেয়েদের কোনো বাধার সম্মুখিন হতে হচ্ছে?

ইফফাত ফাইরুজ: আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়েছে। এটা দেখে তো প্রতিটা পরিবারই ভয় পাবে। শুরুর দিকে নিষেধ করেছিল বাসা থেকে। তবে পরে আবু সাঈদ, মুগ্ধ ভাইসহ যারা শহীদ হয়েছেন তাদের ঘটনা দেখে সবাই সবকিছু বুঝতে পারলেন। এরপর ধীরে ধীরে পরিবারের সহযোগিতা পেয়েছি। এখনও পাচ্ছি।

প্রশ্ন: কোন কর্মঘণ্টা কিংবা শিফটিং অনুসরণ করে কি স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করছেন?

ইফফাত ফাইরুজ: আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো শিফটিং চালু করা হয়নি। তবে শিক্ষার্থীরা যে যখন সুযোগ পাচ্ছে সে এসে দায়িত্ব পালন করছে। আমাদের কাজ শুধু শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড় যেমন মুরাদপুর, জিইসি বা দুই নম্বর গেটে হচ্ছে এমন না। পুরো শহরেই কাজ চলছে।

প্রশ্ন: আইন না মানলে আপনারা কী পদক্ষেপ নেন?

আবরার আল ফয়সাল: আমাদের তো আইনি পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ নেই। ছাত্ররা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে। এটা পথচারী, অভিভাবক, চালক সবার কাছে ইতিবাচকভাবে গেছে। তাদের মধ্যে একটা সম্মানবোধ তৈরি হয়েছে। আমরা তাদের অনুরোধ করলে বা আইনের কথা বললে, তারা এটা ইতিবাচকভাবেই নেন। যদি বলি যে এই কাজটা করবেন না, তখন তারা বলে ‘হ্যাঁ করব না। একটু বলে দেন আমরা কি করতে পারি।’ দেখা যায় আমাদের পরামর্শ বা অনুরোধগুলো তারা খুব সহজভাবে নেন।

প্রশ্ন: পানি-খাবার কোত্থেকে আসছে? কে সমন্বয় করছে?

তানভীর আলম: সরকার পতনের পর পুলিশ যখন রাস্তায় ছিল না, তখন ছাত্ররাই নেমে পড়ে। দেখা যাচ্ছে ভরদুপুরে রোদের মধ্যেও শিক্ষার্থীরা দায়িত্ব পালন করছে। এটা দেখে সাধারণ মানুষ শিক্ষার্থীদের জন্য খাবার, পানি, নাস্তা এসব নিয়ে আসছে। এর বাইরে অনেকগুলো সংগঠনও এগিয়ে এসেছে। আমাদের হেল্পিং চিটাগাং গ্রুপ থেকে বিভিন্ন শুভাকাঙ্ক্ষীর সহযোগিতায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি খাবার প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে।

প্রশ্ন: প্রশাসনের প্রতি আপনাদের কোন পরামর্শ থাকলে বলুন-

আবরার আল ফয়সাল: আমাদের পরামর্শ হলো, এই যে গ্রাফিতি করছে শিক্ষার্থীরা, এখানে কিন্তু ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ফুটে উঠছে। এগুলো যেন সংরক্ষণ করা হয়। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় পার্টটাইম বেসিসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদের কাজের সুযোগ করে দিলে সকলেই উপকৃত হবেন। মাঠ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হলে তার সুফল পাবেন জনগণ।

প্রশ্ন: আপনাদের এসব কার্যক্রম কতদিন চলবে?

রিজাউর রহমান: ছাত্ররা যতদিন মনে করে যে এখনও রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজন, ততদিন মাঠে থাকবে। ছাত্ররা তো শেষ হয়ে যাবে না। নতুন নতুন প্রজন্ম আসবে।

প্রশ্ন: সুন্দর দেশ গড়তে কী রকম অংশগ্রহণ চান?

রিজাউর রহমান: রাষ্ট্রের প্রয়োজনে-দেশের প্রয়োজনে ছাত্ররা কখনোই পিছপা হবে না। স্বেচ্ছাসেবীধর্মী কাজ করে যাবে। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে দেখা যায়- যারা বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত, তাদের সামাজিক কাজ করার একটা শাস্তি দেয়া হয়। এটা বাংলাদেশেও করা যায়। তখন অপরাধ কমে যাবে, মানুষের প্রতি সবার দায়বদ্ধতা তৈরি হবে। এর বাইরে কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রত্যেকটা জায়গায় যেখানে সুযোগ আছে, সেখানে ছাত্রদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যেতে পারে। তাহলেই আমাদের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে সেগুলো মোকাবেলা করা যাবে।

পূর্বকোণ/এসএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট