ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ১২টা গড়িয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নগরীর কর্নেলহাট বাজারের লাগোয়া ‘১০ শয্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু হাসপাতাল’। ঢুকতেই চোখে পড়ল অপেক্ষমাণ বেশ কয়েকজন নারী। নিচ তলার বারান্দা এবং দ্বিতীয় তলায় অবস্থান করা এসব নারীর মধ্যে আছেন বেশ কয়েকজন প্রসূতিও। পাশের কক্ষে দেখা মিলল একজন পরিবার কল্যাণ কর্মীর। কথা বলছেন দুই-তিনজন নারীর সঙ্গে। ঠিক তার বিপরীতে আরেকটি কক্ষে মনদিয়ে এক প্রসূতির কথা শুনছেন একজন নারী চিকিৎসক। এসব নারীরা কেউ হবু গর্ভবতী কেউ আবার গর্ভপরবর্তী সেবা নিতে এসেছেন।
তাদের একজন নগরীর কাট্টলী এলাকার বাসিন্দা সুলতানা বেগম। প্রসঙ্গক্রমে এ নারী বলেন, ‘গত ফেব্রুয়ারি মাসে হাসপাতালটিতে আমার সন্তান প্রসব হয়। এখন এসেছি, নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে। এছাড়া শারীরিক কিছু সমস্যার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে এসেছি।’
খবর নিয়ে জানা গেল- সুলতানার মতো চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে হাসপাতালটিতে সাধারণ প্রসব হয়েছে ৪২ জন প্রসূতির। পরবর্তী মাসেও চল্লিশের অধিক সাধারণ প্রসব (নরমাল ডেলিভারি) হয় এ হাসপাতালটিতে। শুধুমাত্র ডেলিভারিতেই সীমাবদ্ধ নয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি। বছরে শিশুসহ ২০ হাজারের বেশি মায়ের সেবা প্রদান করে যাচ্ছে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের আওতাধীন সেবা কেন্দ্র। যা অত্র অঞ্চলের মানুষের কাছে আস্থার ঠিকানা হিসেবেও ইতোমধ্যে ঠাঁই পেয়েছে।
স্বাস্থ্য সেবায় কমতি না থাকলেও হাসপাতালটির সীমাবদ্ধতা কোন কম নয়। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা সেবা দিয়ে আসলেও প্রকট সংকট রয়েছে জনবলের। বছরে প্রায় ২০ হাজার মানুষের সেবা দেন দুই চিকিৎসকসহ মাত্র ৬ জন কর্মীই। শুধু জনবলের সংকট নয়, আছে যন্ত্রাপাতি ও অবকাঠামোগত সংকটও। অস্ত্রোপচারের কক্ষ থাকালেও পর্যাপ্ত চিকিৎসক-জনবল ও যন্ত্রপাতি না থাকায় সেটিও অদ্যাবধি চালু করা যাচ্ছে না। যদিও এতসব ঘাটতির মধ্যেও মাতৃসেবায় অনন্য স্থানে আছে কর্নেলহাটের ১০ শয্যার মা ও শিশু হাসপাতালটি।
জানা যায়, ১০ শয্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু হাসপাতালটিতে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ ছাড়াও দুটি কক্ষ নিয়ে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের আওতাধীন সরকারি আউটডোর ডিসপেনসারির মাধ্যমেও সেবা প্রদান করা হয়। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের আওতায় হাসপাতালটিতে শুধুমাত্র মা ও শিশুদের সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে।
কর্নেলহাটের ১০ শয্যা বিশিষ্ট মা ও শিশু হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. হ্যাপী কর্মকার বলেন, ‘২৪ ঘণ্টা ডেলিভারি সেবার পাশাপাশি বিনামূল্যে পরামর্শ প্রদান করা হয়। বহির্বিভাগে সরকারি বন্ধের দিন ছাড়া বাকি দিনগুলোতে সকাল আটটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সেবা ও পরামর্শ দেওয়া হয়। গর্ভকালীন ও গর্ভোত্তর সকল মায়েদের প্রয়োজনীয় চেকআপ, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সেবা, কিশোর কিশোরীদের প্রয়োজনীয় সেবা ও পরামর্শসহ পরিবার পরিকল্পনা সংক্রান্ত সকল সেবা প্রদান করা হয়। তবে জনবলের প্রকট সংকট রয়েছে। পর্যাপ্ত জনবল থাকলে সেবার পরিধি আরও বাড়ানো সম্ভব হবে বলে আশাবাদী।’
চট্টগ্রাম জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ডা. ছেহেলী নার্গিস বলেন, পরিবার পরিকল্পনায় কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চ্যালেঞ্জ নিয়ে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বলেই তৃণমুল পর্যায় থেকে শুরু করে শহরাঞ্চলেও সেবার মান দৃশ্যমান হচ্ছে। যদিও অনেকগুলো সংকট আছে, তা যদি সমাধান করা যায়, তাহলে সেবার পরিধি আরও বাড়ানো সম্ভব।
৬ জনে চলে হাসপাতাল: ১০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল হলেও মাত্র দুইজন মেডিকেল অফিসার দিয়ে চলছে হাসপাতালটি। পদও সৃষ্টি আছে মাত্র দু’জনের। অন্যান্য পদগুলোতেও লোকবল নেই বললেই চলে। ২৪ ঘণ্টা সেবা দিতে গিয়ে পুরোই হিমশিম খেতে হচ্ছে। একটি মাত্র মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদ থাকলেও কেউই কর্মরত নেই। ফার্মাসিস্ট আছেন একজন। পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকার পদ চারজন থাকলেও আছে মাত্র ২ জন। বাকি দুই পদই খালি। একজন অফিস সহকারী পদের বিপরীতে আছে একজন, তবে অফিস সহায়ক পদ একজনের থাকলেও তা খালি রয়েছে। তিনজন সহকারী নার্সিং এটেনডেন্ট পদ থাকলেও একজনও নেই। একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মীর পদ থাকলেও পরিচ্ছন্নতা কর্মী ছাড়াই চলছে কার্যক্রম। সবমিলিয়ে আট পদের বিপরীতে ১৪ জন জনবলের অনুমোদন আছে। তবে নিয়োজিত আছেন মাত্র ৬ জন। বাকি আটটি পদই শূন্য।
সেবাদানের চিত্র : পরিবার পরিকল্পনার আওতায় কার্যক্রম শুরু হয় ২০২১ সাল থেকে। যাত্রা শুরুর বছরেই প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক মানুষকে সেবা দেয় স্বাস্থ্য কল্যাণটি। এরমধ্যে ১৮ জনের নরমাল ডেলিভারি হয়। গর্ভবতীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ৬৪৯ জনের, গর্ভপরর্তী সেবা নেন ৭৯ জন, সাধারণ রোগী সেবা নেন ১৮৮০ জন, শিশু ২০৭ জন, পরিবার পরিকল্পনা সেবা ৮৯৭ জন এবং ১৮৬ জন কিশোরী সেবা গ্রহণ করেন ২০২১ সালে। তবে পরবর্তী বছর থেকে সেবার পরিধি বাড়তে থাকে। এ বছর শুধুমাত্র নরমাল ডেলিভারি হয় ৮০ জনের। ২০২৩ সালে যা দাঁড়ায় ৩০৫ জনে। ২০২৪ সালের প্রথম দুই মাসেই ৮০ জনের অধিক নরমাল প্রসব হয়েছে হাসপাতালটিতে। ২০২৩ সালে ১৯ হাজার ৪৮০ জনকে সেবা প্রদান করা হয়।
পূর্বকোণ/পিআর