বাংলাদেশে জনপ্রিয় পর্যটন শহর কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মাণাধীন রেলপথ নিয়ে চলছে আলোচনা সমালোচনা। রেলপথে ঢাকা থেকে কক্সবাজার যাবার আশায় অপেক্ষায় থাকা অনেকেই নতুন রেললাইনের ভগ্নদশা দেখে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের এ মেগা প্রকল্প কতটা জলবায়ুর বান্ধব, টেকসই আর পরিকল্পিত হচ্ছে তা নিয়েও। অগাস্ট মাসের শুরুতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি ঢলে রেললাইনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রেললাইনটি সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাতকানিয়ার তেমুহনী এলাকায় আধা কিলোমিটার জুড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত অংশে রেললাইন উঁচু-নিচু হয়ে আছে। স্লিপারের মাঝে পাথর সরে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। সংস্কার ছাড়া এ পথে রেল চলাচল শুরু করা একেবারেই অসম্ভব।
সামান্য ক্ষতি?
চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত যাবার পথে নতুন রেললাইনের এ ক্ষতিকে নগন্য হিসেবে দেখছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। বলা হচ্ছে, রেলপথের এই ক্ষতি মেরামতে দু’সপ্তাহ কাজ করতে হবে। “যে ক্ষতি হয়েছে এটা যদি আমাদের চালু কোনো রেললাইন হতো তাহলে আমরা একদিনে ঠিক করে ফেলতে পারতাম। আমার যে ক্ষতিটা হয়েছে এই ক্ষতির পরিমাণ তো খুব বেশি না। নগন্য এ ক্ষতির পরিমাণ। রেললাইনের ক্ষতিকে সামান্য দাবি করা হলেও এটিকে মোটেও খাটো করে দেখতে চান না বিশেষজ্ঞরা। ড. আইনুন নিশাত বলেন, যেটা ঘটে গেছে সেটা কেন ঘটেছে সেটা হিসাব-নিকাশ করা হোক। কেন ভেঙেছে এই কারণটা খুঁজে বের করে ভবিষ্যতে যাতে এই ভুল না হয় সেটা ঠিক করতে হবে। সমাধান প্রশ্নে প্রকল্প পরিচালক বলেন, “সমাধান তো অনেকগুলোই আছে। বিশেষজ্ঞরা যে মতামত দেয় সে মতামত আমরা সাদরে গ্রহণ করবো।”
রেললাইন কেন ক্ষতিগ্রস্ত ?
স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন, নতুন এই রেললাইনে যে বাঁধ দেয়া হয়েছে সেখান থেকে পাহাড়ি ঢলের পানি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কালভার্ট ও ব্রিজ নির্মাণ করা হয়নি। রেললাইনের সাথে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, সেখানে আরো বেশি কালভার্ট রাখার প্রয়োজন ছিল। যেগুলো তৈরি হয়েছে সেগুলো আরো প্রশস্ত করে বানানোর প্রয়োজন ছিল বলেও মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয় একজন কৃষক আবুল কালাম রেললাইনের সঙ্গে সমান্তরাল সড়ক বিভাগের রাস্তা দেখিয়ে বলেন, একই দূরত্বে সড়কের চেয়ে রেললাইনে কম কালভার্ট দেয়া হয়েছে। যেগুলো দেয়া হয়েছে সেগুলোর রাস্তার চেয়ে কম প্রশস্ত। রাস্তার যে দূরত্বে চারটি বড় কালভার্ট দেখা যায়, তার বিপরীতে একই দূরত্বে রেলপথে দুটি কালভার্ট চোখে পড়ে।
এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য নকশা ও পরিকল্পনায় স্থানীয় জনসাধারণের অভিজ্ঞতা ও মতামতকে যথাযথ বিবেচনা করা হয়নি। এমনটাই মনে করেন নাগরিক সংগঠন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি এবং প্রকৌশলী সুভাষ চন্দ্র বড়ুয়া। আমরা মনে করি আপনি ইঞ্জিনিয়ার না, আপনার সাথে কী আলাপ করবো ? নো। আপনি প্রত্যেকদিন ওই জায়গা দিয়ে হাঁটছেন। কোথায় কী প্রবলেম সেটা আমার থেকে বেশি জানেন। ওরাতো আর আমাদের এখানে থাকে না। ওরা আমাদের নিত্যদিনের সমস্যা কী সেটাতো জানে না,” বলেন মি. বড়ুয়া।
তবে কালভার্টের সংখ্যা কমানো হয়নি বরং বাড়ানো হয়েছে বলে দাবি করেন প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান। তিনি জানান কক্সবাজার রেললাইনের একশ কিলোমিটারে ১৭৩টি কালভার্ট, ৩৮টি ব্রিজ তৈরি হয়েছে। একশ কিলোমিটার রেললাইনে সাড়ে চার কিলোমিটার জায়গা পানি নিষ্কাশনের জন্য ওপেন রাখা হয়েছে। রেললাইনের ক্ষতির কারণ হিসেবে রেকর্ড বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলকেই দায়ী করছেন প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
রেল কর্তৃপক্ষ ক্ষতির জন্য কেবল অতিবৃষ্টিকে দায়ী করলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। জলবায়ু পরিবর্তন ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, “পানি নিষ্কাশনের জায়গাটা তারা ঠিকমতো রাখেনি। যিনি ফিজিবিলিটি করেছেন তিনি রাখেননি, যিনি ডিটেইল ইঞ্জিনিয়ারিং করেছেন তিনি রাখেননি। যিনি অ্যাপ্রুভ করেছেন তিনি দেখেননি।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, আন্তর্জাতিক পরামর্শকরা বিগত একশ বছরের বন্যা, জলোচ্ছ¡াস ও বৃষ্টির হিসেব করেই এ প্রকল্পের ডিজাইন করেছে। কিন্তু এবার সব রেকর্ড ভেঙে দুই দিনে এক মাসের সমপরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে।
রেললাইনের ক্ষতি এবং বন্যা ও জলাবদ্ধতার ক্ষয়ক্ষতির কারণে ড. নিশাত ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, “প্রচুর ওপেনিং রাখার দরকার ছিল যাতে করে পানি বেরিয়ে যেতে পারে। এটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফেইলিওর। আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার, আমি খুবই লজ্জিত। হাইড্রোলজিক ফেইলিওর, আমি হাইড্রোলজি পড়িয়েছি আমি খুবই লজ্জিত, পিওর ফেইলিওর।”
পূর্বকোণ/এএইচ