বীর মুক্তিযোদ্ধা, চট্টগ্রাম-১০ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ডা. আফছারুল আমীন আর নেই (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)। দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ রোগভোগের পর আজ শুক্রবার বিকাল ৩টা ৫৫ মিনিটে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। তিনি চিকিৎসক স্ত্রী, দুই ছেলে, পাঁচ ভাই, চার বোনসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। প্রবীণ এই রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমেছে রাজনৈতিক অঙ্গণে।
আজ শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় বঙ্গবন্ধু এভেনিউয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে তার প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর সংসদ ভবনের সামনে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য লাশ রাখা হবে বলে জানিয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক শফিকুল ইসলাম। তিনি আরও জানান, শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে হেলিকপ্টারযোগে মরহুমের লাশ চট্টগ্রামের হালিশহর বিডিএর (বিজিবি) ক্যাম্প মাঠে আনা হবে। সেখান থেকে দক্ষিণ কাট্টলী ডা. ফজলুল আমীনের বাড়ি তথা নিজ বাড়িতে লাশ নিয়ে যাওয়া হবে। ৪টার সময় জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ ময়দানে লাশ আনা হবে। বাদ আছর দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে লাশ ফের বাড়িতে নেয়া হবে। বাদ এশা পিএইচ আমিন একাডেমি মাঠে তৃতীয় নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার পিতা-মাতার কবরের পাশে দাফন করা হবে।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ডা. আফছারুল আমীনের ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে। প্রথমে তিনি সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। এরপর দেশে নিয়মিত চিকিৎসা নেন। গত কিছুদিন ধরে তার শারীরিক অবস্থা খারাপ ছিল।
রাজনীতি ও চিকিৎসা সেবা প্রদানের পাশাপাশি শিক্ষাখাতেও অবদান রেখেছেন আফছারুল আমীন। নগরীর দক্ষিণ কাট্টলী এলাকায় তার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে ‘প্রাণহরি আমীন একাডেমি’। এই একাডেমির অধীনে এবং এর বাইরেও একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। আফছারুল আমীনের দুই সন্তানের মধ্যে ফয়সাল আমীন পারিবারিক ব্যবসা পরিচালনা করেন এবং ছোট ছেলে মাহিদ বিন আমীন বাবার মতোই চিকিৎসক। চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার পদে আছেন তিনি।
চট্টগ্রাম-১০ আসনের তিনবারের এমপি দুই দফা সফলতার সাথে মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা আফছারুল আমীন এমপি’র রয়েছে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন। তার পিতার নাম মরহুম ডা. মো. ফজলুল আমীন তিনি ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি নগরীর দক্ষিণ কাট্টলীতে পৈত্রিক নিবাসে জন্মগ্রহণ করেন। এই চিকিৎসক রাজনীতিক ১৯৯১ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষের সেবা করে আলোচনায় আসেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ডা. মাহফুজুর রহমানের নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডে প্রতিবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং এর ধারাবাহিকতায় তৎকালীন সাময়িক শাসক জিয়াউর রহমানের নির্দেশে গ্রেপ্তার হয়ে চট্টগ্রাম ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাভোগ করেন। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৮৪ সালে দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ে পতেঙ্গা হতে কাট্টলী পর্যন্ত দূর্যোগপূর্ণ এলাকায় একাধিক ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করে সেবা দান করেন। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী জাপান সরকারের সহায়তায় জাতীয় অধ্যাপক মরহুম ডা. নুরুল ইসলাম সহ উপকূলীয় অঞ্চলে ঘরবাড়ি নির্মাণে সহায়তা করেন। ১৯৯২ সালে স্বাধীনতার স্বপক্ষে চিকিৎসক সমাজ হতে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম শাখার সাধারন সম্পাদক পদে প্রার্থী হন। ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯৩-৯৬ সাল পর্যন্ত পাহাড়তলী থানার আওতাধীন চট্টগ্রাম পশ্চিমাঞ্চলে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ এর পক্ষ হতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবীর আন্দোলনে দায়িত্বপালন করেন। ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে ৭ম ও ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেন। ২০০৬ সালে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৯ (২৮৬) আসন হতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারী নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং ৩১ জুলাই ২০০৯ ইংরেজি হতে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী ছিলেন। ২০১৩ সালে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১০ (২৮৭) আসন হতে দ্বিতীয় বারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০১৮ পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হতে আজীবন সম্মাননা পদে ভূষিত হন। ২০১৮ সালের ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-১০ (২৮৭) আসন হতে তৃতীয় বারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদে দায়িত্বরত ছিলেন। ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট মেম্বার পদে ভূষিত হন।
পূর্বকোণ/জে/এএইচ