১৩ বার চিঠি দিয়েও অকেজো হয়ে পড়ে থাকা একমাত্র এমআরআই মেশিন এখনো সচল করতে পারেনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি নিয়ে দরকষাকষির কারণে মেশিনটি সচল করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। যার কারণে প্রায় দশ কোটি টাকা খরচ করে জাপান থেকে কেনা এমআরআই মেশিনটি দুই বছর ধরে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে মেশিনটি বন্ধ থাকায় সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েছেন সাধারণ রোগীরা, অন্যদিকে রাষ্ট্রও হারাচ্ছেন রাজস্ব।
জানা যায়, ২০১৬ সালের ২৮ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ওষুধাগার বা সিএমএসডির ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেডিটেল প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে এমআরআই মেশিন ক্রয়ের চুক্তি হয়। চুক্তি মোতাবেক ২০১৭ সালের ১৬ আগস্ট চমেক হাসপাতালে স্থাপন করা হয় মেশিনটি। চুক্তি অনুযায়ী মেশিনটির ওয়ারেন্টি পিরিয়ড ছিল তিন বছর। সে হিসেবে ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি ছাড়াই সেবা গ্রহণ করতে পারেন রোগীরা। কিন্তু চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র দুই মাসের মাথায় বিকল হয়ে পড়ে কোটি টাকার এ মেশিন। পরবর্তীতে সাড়ে ৯ লাখ টাকা খরচে মেরামত করার পর বেশ কিছুদিন সচল ছিল মেশিনটি। সবশেষ ২০২১ সালের ২৪ মে ফের বিকল হয়ে যায় কোটি টাকা মূল্যের এমআরআই। এরপর থেকে মেশিনটি অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানায়, একমাত্র মেশিনটি সচলের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে অন্যান্য দপ্তরে বহু সংখ্যক চিঠি চালাচালি করা হলেও এখন পর্যন্ত কোন সুরহা হয়নি। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রায় কোটি টাকার ব্যয় বিবরণী দেয়া হলেও সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত না হওয়ায় মেশিনটি মেরামত করা যাচ্ছে না। ফলে অচল হয়ে পড়ে থাকায় মেশিন থেকে সেবাও গ্রহণ করতে পারছেন না সাধারণ রোগীরা। এতে গরিব রোগীদের বাড়তি টাকা খরচ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করাতে হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দেশের সকল সরকারি হাসপাতালের উচ্চ প্রযুক্তির মেডিকেল যন্ত্রপাতি সার্বক্ষণিক চালু রাখার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে ‘রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি’ বা সিএমসি করার জন্য একটি গাইডলাইন প্রণয়ন করা হয়। গাইডলাইন অনুযায়ী চমেক হাসপাতালের এমআরআই মেশিনটির ক্রয় মূল্যে ৪ শতাংশ হারে সিএমসি করলে এ জন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে বছরে দিতে হবে ৩৯ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। কিন্তু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান দাবি করেন ৯৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ৫৪ লাখ ১৪ হাজার টাকা বেশি দাবি করে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও ২০২১ সালে এসে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গাইডলাইন পুনরায় সংস্কার করে সিএমসি করার জন্য সাড়ে ৬ শতাংশে বৃদ্ধি করা হয়। সে হিসেবেও এমআরআই মেশিন বাবদ ৬৩ লাখ ৯৬ হাজার টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও তাতেও রাজি নয় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। বরং তাদের বাড়তি ২৯ লাখ ৫৪ হাজার টাকা বেশি দিতেই অনড় থাকে প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে দুই পক্ষকে অন্তত ১৩ বার চিঠি পাঠায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেন, ‘সরকারি গাইডলাইন অনুযায়ী বারবার মেশিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রস্তাবনা দেয়া হলেও তারা (সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান) তাদের দাবিতে অনড় রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষকেও অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন সুরহা হয়নি। যার কারণে মেশিনটি সচল করা যাচ্ছে না। তবে মেশিন সচল করতে প্রয়োজন হলে মন্ত্রীর সাথেও কথা বলা হবে। কোনভাবেই রোগীরা সেবা বঞ্চিত হোক, সেটি চাই না। যদিও নতুন মেশিনের জন্য বহু আগেই মন্ত্রণালয়ে চাহিদা প্রেরণ করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে যদি নতুন মেশিন পাওয়া যায়, সে বিষয়েও বারবার যোগাযোগ করা হচ্ছে।’
প্রসঙ্গত শরীরের বিভিন্ন অংশের সুক্ষ রোগ নির্ণয়ের জন্য বর্তমানে এমআরআই একটি নির্ভরযোগ্য যন্ত্র হিসেবে চিকিৎসকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। মস্তিষ্ক রোগ (টিউমার, স্ট্রোকসহ সব), মেরুদণ্ড, জয়েন্ট (হাঁটু, কাঁধ, কব্জি, এবং গোড়ালি), পেট, স্তন, রক্তনালী, হার্ট এবং শরীরের অন্যান্য অংশের পরীক্ষার জন্য এমআরআই ব্যবহার করা হয়। এ সেবা এতদিন চট্টগ্রামের সরকারি এ হাসপাতালেই পাওয়া যেত।
পূর্বকোণ/এ