ভয়াবহ সংকটের মধ্যেও জাতীয় গ্রিড থেকে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ না করায় ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নেতারা প্রশ্ন তুলেছেন, জাতীয় গ্রিড থেকে চট্টগ্রামকে কি বের করে দেওয়া হয়েছে? দুর্যোগের সময়ও জাতীয় গ্রিড থেকে চট্টগ্রামে কেনো গ্যাস দেওয়া হলো না? গ্যাসের জাতীয় গ্রিড থেকে চট্টগ্রামকে কেনো বিচ্ছিন্ন করা হলো? চট্টগ্রামকে কেনো পুরোপুরি এলএনজি নির্ভরশীল করা হলো?
গতকাল কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) ভবনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সভায় এসব প্রশ্ন তুলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন ব্যবসায়ী নেতারা। বৃহত্তর চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ সংক্রান্ত বিষয়ে অংশীজনদের নিয়ে এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে কেজিডিসিএল কর্তৃপক্ষ। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ওয়াসিকা আয়শা খান এমপি।
সভায় বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি রকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, আমরা এতোদিন জানতাম, গ্যাস ও বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিড থেকেই আসে। ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ আসার পর জানতে পারলাম- আমরা এলএনজি নির্ভর হয়ে পড়েছি। ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছি আমরা। সেই অনুযায়ী বিনিয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু দিনশেষে দেখছি গ্যাস নেই। এভাবে চললে আমাদের আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকবে না। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবো না।
বিজিএমইএ’র পরিচালক মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, আগে আমরা গ্যাস পেতাম জাতীয় গ্রিড থেকে। গ্যাসের প্রবাহ কমে যাওয়ায় এখন এলএনজি আনা হচ্ছে। দুর্যোগ হতে পারে। এলএনজি থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হতে পারে। কিন্তু জাতীয় গ্রিড থেকে চট্টগ্রামকে কি বের করে দেওয়া হয়েছে? দুর্যোগের সময় জাতীয় গ্রিড থেকে আমাদের কেনো গ্যাস দেওয়া হলো না? হঠাৎ এলএনজি থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হওয়ার পর জাতীয় গ্রিড থেকে গ্যাস পাওয়ার ক্ষেত্রে কেনো আমরা বঞ্চিত হলাম?
সিএন্ডএফ এজেন্টস এসোসিয়েশনের প্রথম সহ-সভাপতি আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু বলেন, আজকের এই দুর্যোগের সময় কেনো আমরা জাতীয় গ্রিড থেকে গ্যাস পেলাম না? আজকে চট্টগ্রামের প্রতিটি বাসায় গ্যাসের জন্য হাহাকার। ১৪ ও ১৫ মে আমাদের কি অবস্থা গেছে- সেটা বলার মতো না। চট্টগ্রামকে যেন পের জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করা হয়। জাতীয় গ্রিড থেকে যেন আমরা গ্যাসের সরবরাহ পাই। এটা চট্টগ্রামের মানুষের দাবি। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের প্রাণের দাবি।
ওয়েল গ্রুপের এমডি সিরাজুল ইসলাম কমু বলেন, এখন ২৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে আমাদের। শুধু প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর নির্ভর না করে এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। এটা শিল্প বিপ্লবের জন্য খুব জরুরি ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে- মঙ্গলবার ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎও উৎপাদন হয়নি। গ্যাসও পর্যাপ্ত দেওয়া হচ্ছে না। দুর্যোগ এলে এলএনজি টার্মিনাল বা জাহাজ সরিয়ে নেওয়া হতে পারে। কিন্তু গ্যাসের জাতীয় গ্রিড থেকে কেনো চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করা হলো?
জিপিএইচ গ্রুপের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমাস শিমুল বলেন, আমরা জাতীয় গ্রিডের বাইরে কেনো থাকবো? আমরা তো বাংলাদেশের বাইরের কেউ না। সবাই তো একই দেশের মানুষ। পুরো দেশের ম্যাক্সিমাম রেভিনিউ চট্টগ্রাম থেকেই যায়। দেশে বড় বড় যে ইন্ডাস্ট্রিগুলো আছে- সেগুলো চট্টগ্রামের। তাহলে তারা জাতীয় গ্রিডের বাইরে কেনো থাকবে? আমাদের কানেক্টিভিটি বাড়াতে হবে। কানেক্টিভিটি বাড়ানো না হলে চট্টগ্রামের গুরুত্ব বাড়বে না।
বিএসআরএম গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, শিল্পায়নের জন্য বিদ্যুৎ এবং গ্যাস লাগবেই। বিদ্যুৎ-গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ না পেলে শিল্পায়ন হবে না। প্রধানমন্ত্রী এটি বুঝতে পেরেছেন বলেই বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এলএনজি আমদানি করছেন গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য। আমি আপনাদের অনুরোধ করবো- আমরা যারা শিল্পে বিনিয়োগ করছি- তাদের যেন সহায়তা দেওয়া হয়। গ্যাসের লোড যেন বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
এফবিসিসিআই’র পাওয়ার, এনার্জি এন্ড ইউটিলিটিজ বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির কো-চেয়ারম্যান মাহফুজুল হক শাহ বলেন, এলএনজি সংযোগ ডিসকানেক্ট হতেই পারে। এটা রিকানেক্ট করতে যে প্রসিডিউরগুলো আছে সেটাও করতে হবে। ক্যাপাসিটি বিল্ডআপ করার বিষয় আছে। সেটাও করতে হবে। কিন্তু সব সিদ্ধান্ত ঢাকা থেকে কেনো নেওয়া হবে? কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি কর্তৃপক্ষকেইতো সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সিদ্ধান্ত চট্টগ্রাম থেকে নিলে আমাদের অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
পিএইচপি ফ্যামিলির প্রতিনিধি শেখ কুতুব উদ্দিন বলেন, ভবিষ্যতে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’র মতো দুর্যোগ এলে- যেন আমরা জাতীয় গ্রিড থেকে গ্যাস পাই। সরবরাহ অব্যাহত থাকে। তিনি বলেন, বলা হচ্ছে আমরা এখন এলএনজির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এলএনজি আসার পরেও চট্টগ্রামে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাই না। ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। অথচ জাতীয় গ্রিডের প্রাকৃতিক গ্যাস আমাদের দেওয়া হয় না। চট্টগ্রাম কেনো এভাবে শূন্য হয়ে যাবে?
চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক অঞ্জন শেখর দাশ বলেন, প্রধানমন্ত্রী ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করেছেন। এগুলো চালু করতে গ্যাস-বিদ্যুৎ দিতেই হবে। বিদেশি বিনিয়োগ আনতে আমরা কাজ করছি। গ্যাস-বিদ্যুৎ না পেলে বিনিয়োগ আসবে কীভাবে? এই জিনিসগুলো মাথায় রাখতে হবে।
ব্যবসায়ীদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতে কেজিডিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, জাতীয় গ্রিড থেকে চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন- কথাটা আসলে এরকম না। আমরা জাতীয় গ্রিডের সঙ্গেই আছি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে- আগে ওদিক থেকে গ্যাস আসতো। এখন এখান থেকে ঢাকায় গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এলএনজি থেকে দৈনিক ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমরা চট্টগ্রামে সরবরাহ করছিলাম। বাকি ৪০০-৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি ঢাকায় যাচ্ছিলো।
তিনি বলেন, ২০১৮ সালে এলএনজি সরবরাহ শুরু হয়। এই ৪-৫ বছরে অনেকগুলো ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। কিন্তু এলএনজি সরবরাহ বন্ধ হয়নি। যেহেতু এখন এদিক থেকে ঢাকায় গ্যাস পাঠানো হচ্ছে- হঠাৎ করে ওদিক থেকে এদিকে গ্যাসের ফ্লো দেওয়া যাবে না। এটা টেকনিক্যাল বিষয়। বুঝতে হবে। এলএনজির ৭০০-৭৫০ মিলিয়ন গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শুধু চট্টগ্রাম নয়- সারাদেশেই এর প্রভাব পড়েছে। তবে এটা সাময়িক। খুব দ্রুত আমরা এলএনজির সরবরাহ স্বাভাবিক করার জন্য কাজ করছি।
মতবিনিময় সভায় দেওয়া ব্যবসায়ীদের বক্তব্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেন প্রধান অতিথি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ওয়াসিকা আয়শা খান। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শুধু স্বপ্ন দেখাচ্ছেন না। স্বপ্ন বাস্তবায়নও করছেন। শিল্পায়ন এবং উন্নয়নের কারণে গ্যাস-বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা সবাই অংশীদার।
কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড’র (কেজিডিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে সভায় আরও বক্তব্য দেন পিডিবি দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম, বিকেএমইএ’র পরিচালক গাজী মো. শহীদুল্লাহ, ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজের হোসাইন। সভায় কেজিডিসিএল’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সংস্থাটির অংশীজনরা অংশ নেন।
পূর্বকোণ/পিআর