চট্টগ্রাম রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

ইলমার মুক্তি মিললো মৃত্যুতে

নাজিম মুহাম্মদ

২৩ অক্টোবর, ২০২২ | ১০:২৯ পূর্বাহ্ণ

মায়ের কোলে নিরাপদ থাকতে পারল না সাত বছরের শিশু হোছনে আরা ইলমা। পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে নিজের সন্তানকে মৃত্যুর দুয়ারে টেলে দেয় বিউটি। মা এবং পরকীয়া প্রেমিক মনিরুল (৩০) মিলে প্রতিদিন শারীরিক নির্যাতন করতো শিশুটিকে। অবোধ শিশুটি নির্যাতনের কথা কাউকে বলতেও পারত না। কারণ শিশুটিকে বাসা থেকে বের হতে দিত না। টানা নির্যাতনে শিশু ইলমা খুব একটা নড়াচড়া করতে পারত না।

গত ১৫ অক্টোবর মনিরুল পেটে সজোরে ঘুষি দিলে নিস্তেজ হয়ে যায় শিশু ইলমা। ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। ঘটনার পর পরই সন্তানের হত্যাকারীকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে বিউটি। প্রতিবেশী লোকজন বিউটিকে আটকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এ ব্যাপারে বন্দর থানায় বিউটি ও মনিরুলকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করে বিউটির ফুফাতো ভাই ওমর আলি মোল্লা। ঘটনার ছয়দিনের মাথায় শুক্রবার রাতে বাগেরহাটের মোড়লগঞ্জ থেকে ঘাতক মনিরুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই-চট্টগ্রাম মেট্রো)।

 

পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার (মেট্রো) নাঈমা সুলতানা জানান, মনিরুলের সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে নিজের সন্তানকে হত্যার পরিকল্পনা করে বিউটি। শিশুটিকে দু’জনে মিলে প্রতিনিয়ত শারীরিক নির্যাতন করত। এক পর্যায়ে শিশুটিকে হত্যা করে তারা। ঘটনার পর পরই বিউটিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মনিরুলকে গ্রেপ্তার করে গতকাল শনিবার আদালতে পাঠানো হয়েছে। শিশু ইলমাকে শারীরিক নির্যাতন ও হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে মনিরুল।

 

পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মনিরুল বলেন, তার বাড়ি বাগেরহাটে। পেশায় রিক্সাচালক। ২০০৯ সালে শরনখোলার ময়না বেগমের সাথে তার বিয়ে হয়। তাদের একটি শিশু সন্তান রয়েছে। ময়না নগরীর একটি গার্মেন্টসে চাকরি করত। আনুমানিক এক বছর আগে ফুফাতো বোন বিউটি গার্মেন্টসে চাকরি করতে চট্টগ্রামে আসে। মাসিক খোরাকি দিয়ে মনিরুলের কলসীদিঘির ভাড়া বাসায় থাকত। ছয়মাস পর বাগেরহাট গ্রামের বাড়িতে গিয়ে টিটু নামে একজনকে বিয়ে করে বিউটি। ছয়মাস পর তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে ফুফু কারিমা বেগম হাসান নামে আরেকজনের সাথে বিউটির বিয়ে দেয়। ওই সংসারে ইলমা জন্ম হয়। কিছুদিন পর হাসানের সাথেও ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে রাসুল নামে আরেকজনের সাথে বিয়ে হয় বিউটির। কয়দিন পর তার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে ৭/৮ মাস আগে বিউটি চট্টগ্রামে এলে কলসীদিঘির পাড়ে ভাই বোন পরিচয় দিয়ে আমরা একটি বাসা ভাড়া নিই। ইলমা নানী কারিমার কাছে থাকত। বাচ্চা হওয়ার দুইমাস পর স্ত্রী বাগেরহাট বাবার বাড়িতে চলে গেলে নিয়মিত বিউটির সাথে থাকা শুরু করে মনিরুল। এরমধ্যে ইলমাকে নানীর কাছ থেকে নিয়ে আসে বিউটি।

 

মনিরুল জানান, আগের স্বামী হাসানের কথা মনে করে প্রায় সময় ইলমাকে মারধর করত বিউটি। মনিরুলও প্রায় সময় শিশু ইলমাকে শারীরিক নির্যাতন করত। বিউটি মশারি দিয়ে ইলমার গলা চেপে ধরে টানাটানি করত। অতিরিক্ত মারধরের কারণে শিশু ইলমার সারাগায়ে, গলায় অসংখ্য দাগ পড়ে। একপর্যায়ে গিয়ে ইলমা হাঁটতে পারত না। একদিন গোসল করাতে নিয়ে গেলে পা পিছলে পড়ে গেলে মনিরুল মেঝের সাথে ইলমাকে চেপে ধরলে ডান চোখে আঘাত পায়। গত ১২ অক্টোবর শিশুটিকে প্রচণ্ড মারধর করলে বাড়ির মালিক তাদেরকে বাসা থেকে বের করে দেন। পরে কলসীদিঘি বালুর মাঠ এলাকায় আরেকটি বাসা ভাড়া নেয় তারা।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মনিরুল জানান, বিউটি নিজের সন্তান ইলমাকে মেরে সাগরপাড়ে ফেলে দেয়ার পরিকল্পনাও করেছিল। কারণ বিউটির সাথে মনিরুলের বিয়ে হয়নি। বিউটির ধারণা শিশুটি থাকার কারণে মনিরুল তাকে বিয়ে করছে না।

 

হত্যা করা হল ইলমাকে : মনিরুলের ভাষ্যমতে, অতিরিক্ত মারধরের কারণে ইলমা নিজে বাথরুমে যেতে পারত না। একটি বালতিতে প্রস্রাব পায়খানা করানো হতো। গত ১৫ অক্টোবর সকাল এগারেটার দিকে বিউটির বাসায় যান মনিরুল। ওই সময় বিউটি গার্মেন্টসে ছিল। ইলমা তখন ঘুমে ছিল। মনিরুলও ঘুমায়। বিকেল চারটায় ঘুম থেকে উঠে দেখে ইলমা বসে আছে। মনিরুল ভাত খেতে বসে। এসময় পায়ের ধাক্কায় বালতির ময়লা গায়ে পড়লে মনিরুল রেগে পেটে জোরে ঘুষি মারলে ইলমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। শিশুটিকে খাটে শুইয়ে দিয়ে বিউটিকে ফোন করে মনিরুল বলেন, ‘তোর মেয়েকে আমি মারছি, ও যেন কেমন করছে, তুই তাড়াতাড়ি আয়’।

 

ফোনের ওপাশ থেকে বিউটি বলেন, ‘তুই তোর কাজে চলে যা, আমি আসতেছি’। এরপর মনিরুল রিকশা গ্যারেজে চলে যায়। সন্ধ্যার সময় বাগের হাটের গ্রামের বাড়ি থেকে প্রতিবেশী গনি মোল্লা ফোন করে মনিরুলকে জানান, তুই নাকি বিউটির মেয়েকে মাইরে ফেলছিস? এরপর বিউটির খালাতো ভাই সুজন ফোন করে বলেন, ‘বিউটির মেয়ে কোথায়, তুমি কী করছ, তুমি নাকি মেরে ফেলছো, তখন মনিরুল বলেন আমি মাইর দিছি’।

 

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই’র পরিদর্শক ইলিয়াছ খান জানান, ঘটনার পর বিউটিকে গ্রেপ্তার করে বন্দর থানা পুলিশ। মামলাটি আমরা ছায়া তদন্ত করি। শুক্রবার রাতে মনিরুলকে বাগেরহাটের শ্বশুরবাড়ির এলাকার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে মনিরুল গ্রেপ্তার করা হয়। শিশু ইলমা মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হবার পর নিজের মুঠোফোন এবং সিম ভেঙে ফেলে দেয় মনিরুল। বাগেরহাটে না গিয়ে মোড়লগঞ্জে খালা শাশুড়ির বাসায় যায়। বিষয়টি জানালে স্ত্রী ময়না তাকে ভারতে পালিয়ে যেতে পরামর্শ দেয়।

 

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট