চট্টগ্রাম সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্মৃতির দর্পণে চট্টলদরদী ইউসুফ চৌধুরী

৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ | ১২:০২ অপরাহ্ণ

আলহাজ্ব ইউসুফ চৌধুরী। একটি বটবৃক্ষ। যিনি ছায়া দিয়েছেন দেশ, সমাজ এবং পরিবার পরিজনকে। তাঁর শেখর ছিল বিস্তৃত। এই শেখরের জায়গায় তিনি নিজ পরিবারের পাশাপাশি ভাই এর পরিবারগুলোকেও তুলে আনার চেষ্টা চালিয়েছেন অবিরাম। শুধু নিজ ভাই নয়, চাচাত জেঠাত ভাই এর পরিবারগুলিকেও শিক্ষা-দীক্ষায় তুলে আনার জন্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সাহায্য করে গেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

আমি দৈনিক পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব ইউসুফ চৌধুরীর কথা বলছিলাম। চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার সুলতানপুর ইউনিয়নের (বর্তমান রাউজান পৌরসভার অধিন ৮ নং ওয়ার্ড) প্রসিদ্ধ হাজী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন ১৯২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর এবং ইন্তেকাল করেন ২০০৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তারিখে।

রাউজানের আর্যমিত্র থেকে এন্ট্রান্স পাশ করার পর তিনি ব্যবসায় নিয়োজিত করেন নিজেকে। রাউজানের ফকিরহাটে তিনি বইয়ের দোকানের পাশাপাশি ঢাকা এবং করাচি থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকার এজেন্সি নিয়েছিলেন। বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে তিনি রাউজানের ব্যবসা চুকিয়ে চট্টগ্রাম শহরের জুবিলী রোডে কো অপারেটিভ অফিসের বিপরীতে নিউজ ফ্রন্ট নামে একটি বইয়ের দোকানের পাশাপাশি পত্রিকার এজেন্সির কাজ করেন চট্টগ্রাম শহরে।

চট্টগ্রাম শহরে তখন স্কুলের শিক্ষার্থীরা নিজেদের স্কুলের লাইব্রেরির পাশাপাশি নিউজ ফ্রন্টে এসে বই পড়তেন। চল্লিশের দশকের চট্টগ্রামের সাংবাদিকদের আড্ডার জায়গা ছিল নিউজ ফ্রন্ট। জনাব ইউসুফ চৌধুরী সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে ৭০ এর দশকে দোলনা ডাইজেস্ট নামে একটি মাসিক ম্যাগাজিন বের করেছিলেন।

পরে ১৯৮৬ সালে তিনি বের করেন দৈনিক পূর্বকোণ। যেটি গত সাড়ে তিন দশক ধরে চট্টগ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখের, সম্ভাবনার কথা বলে যাচ্ছে। এই পত্রিকাটির সবচেয়ে বেশি প্রচার হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে। বিভিন্ন উপজেলা ও পার্শবর্তী জেলাগুলোর প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাওয়া-না পাওয়া বঞ্চনার কথা সুনিপুণভাবে তুলে ধরা হয় এই কাগজে।

বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে তিনি চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য কাজ করে গেছেন। চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে চট্টগ্রামবাসীর কাছে। বলছিলাম তিনি একটি বটবৃক্ষ। তাঁর কথা লিখতে গেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা যাবে। আমি আজ তাঁর পারিবারিক কিছু স্মৃতি তুলে ধরতে চাই।

ইউসুফ চৌধুরী ২০০৪ সালে গ্রামের বাড়ী হাজীবাড়িতে এক পারিবারিক সম্মিলনের আয়োজন করেছিলেন। তিনি যে কোন কাজ করতে, বিশেষ করে পারিবারিক কাজে তিনি বাড়ীর ছোট বড় সবাইকে ডেকে পরামর্শ করতেন। দুই দিন ব্যাপী এই সম্মেলনের আগে তিনি তার পূর্বকোণস্থ অফিসে কয়েকবার বৈঠক করে কাজ ভাগ করে দিয়েছিলেন। কাউকে বাড়ীতে লোকজনের থাকার ব্যবস্থা করা, আত্মীয় স্বজনদের দাওয়াত করার দায়িত্ব, খাবার-দাবার ম্যানেজ করার দায়িত্ব কয়েকজনকে ভাগ করে দেয়া হয়, অনুষ্ঠানটি যেন সবার উদ্যোগে হয় সেজন্য বাড়ির ভাইপোদের কাছ থেকে অর্থ নিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। তিনি বলতেন অর্থ দিলে সে অনুষ্ঠানকে ‘ওন’ বা ধারণ করবে অর্থাৎ নিজের মনে করবে।

ইউসুফ চৌধুরীরা ছিলেন চার ভাইয়ের তের ভাই এবং দুই বোন। আমাদের সংখ্যায় অর্থাৎ ভাইবোন ছিলাম প্রায় ৭৫ জন। এই পঁচাত্তর জনের ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনি নিয়ে ছিল এই আয়োজন। দুই দিনের আয়োজনে তিন বেলা খাবার এবং তিন বেলা নাস্তার ব্যবস্থা। মেয়ের জামাই এমনকি নাতিন জামাইরাও ছিল এই সম্মিলনে উপস্থিত। আমরা এখন অনেক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি যেটা বাঙালি সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যায় না।

বাঙালি জাতির সমাজবদ্ধতা বিশ্বের একটি নজির স্থাপনকারী বিষয়। নিজেদের মধ্যে, বিশেষ করে ভাই-বোন, ভাইপো-ভাইঝি, তাদের জন্য ছেলেমেয়েদের সাথে পরিচিতি হবার সুযোগ তৈরি করার জন্যই ছিল ইউসুফ চৌধুুরীর এই উদ্যোগ। প্রত্যেকের নিজ নিজ ঘরের পাশাপাশি কাচারী ঘরেও থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। খাবার জায়গা, বসার জায়গা, রান্নার জায়গা আলাদা করার পাশাপাশি ছেলেমেয়েরা যেন আলাদা আলাদা ভাবে বসে আড্ডা দেয়ার মাধ্যমের নিজেদের পরিচয়কে গাঢ় করতে পারে সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছিল এই আয়োজনে। রাতের খাবারের পর বসেছিল গানের আসর।

এতে বাইরের শিল্পী ছাড়াও আমাদের ছেলেমেয়েদেরও গান করার সুযোগ রাখা হয়েছিল। মধ্যরাতে চলে কাউয়ালী গান। গানের সাথে সাথে ছোট বড় মিলে নাচতে ভুলেনি কেউ কেউ। দ্বিতীয় দিনের সকালবেলার নাস্তার জন্য রাত বারটার পর থেকে আয়োজন শুরু হয়। প্রায় সাড়ে তিনশ’ জনের এই বছরের জন্য সারারাত প্রায় হাজার খানেক পরোটা এবং গরুর মাংসের ব্যবস্থা করা হয়। এর পাশাপাশি ডিম ও সবজির ব্যবস্থা রাখতে ভুলেননি আয়োজকরা পারিবারিক সম্মিলন উপলক্ষে একটি টেলিফোন গাইড বের করা হয়েছিল, যাতে বাড়ীর সবার ফোন নাম্বার ছিল।

যেকোন প্রয়োজনে এই গাইডটা সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। প্রাথমিক জীবনে জনাব ইউসুফ চৌধুরী বাড়ির দিকে নজর না দিলেও ভাই-ভাইঝিরা কে কি করছে এবং কে কোন ক্লাসে পড়ছে সব খবর রাখতেন।

বাড়ির প্রতি তার টান বাড়ে শেষের দিকে এসে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিধন্য হাজী বাড়িকে তুলে ধরার জন্য তিনি উদ্যোগী হয়ে বেশ কয়েকবার নজরুল জয়ন্তি পালন করেছেন তাঁর বাড়ির আঙ্গিনায় থাকা ঢেউয়া হাজীপাড়া প্রাইমারি স্কুল প্রাঙ্গণে।

সেখানে মন্ত্রী ছাড়াও কবির নাতনি খিল খিল কাজীকেও নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছিলেন, হাজী বাড়ির পারিবারিক সম্মেলনের মত আরো অনুষ্ঠান করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন জনাব চৌধুরী। কর্মব্যস্ততার কারণে তিনি তা করতে পারেননি, তবে তিনি বাড়ির ছেলেমেয়েদের মধ্যে বোঝা-পড়ার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন বর্তমানেও তা ধরে রাখার চেষ্টা করবেন, তাই আশা করি। কয়েক বছর পর পর এই অনুষ্ঠানটি করা হলে সমৃদ্ধ হাজী বাড়ীর সুনাম আরো ছড়িয়ে পড়বে এবং ইউসুফ চৌধুরীর সম্মান প্রদর্শনের পাশাপাশি তার আত্মাও শান্তি পাবে।

এম নাসিরুল হক সিনিয়র সাংবাদিক।

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট