চট্টগ্রাম সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

চিরস্মরণীয় আলোকবর্তিকা মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী

৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ | ১১:৩৮ পূর্বাহ্ণ

আঞ্চলিকে দেশসেরা পত্রিকা দৈনিক পূর্বকোণ এর প্রতিষ্ঠাতা চট্টলদরদী মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরীর তিরোধানের পনেরো বছর পূর্ণ হলো আজ। চট্টগ্রামবাসীর কাছে স্বমহিমায় উজ্জ্বল এই স্বপ্ন-নির্মাতা ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের এই দিনে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছেন। স্বল্প পরিসরের মহার্ঘ জীবনটিকে তিনি এই জনপদের উন্নয়ন ও জনমানুষের কল্যাণে অকাতরে ব্যয় করে গেছেন। নানাভাবে যুবগোষ্ঠীকে আত্মপ্রত্যয়ী হতে যেমন প্রাণিত করেছেন, তেমনি সারাটি জীবন সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে তিনি বঞ্চনার সব বেড়াজাল কেটে বেরিয়ে এসে আত্মপ্রত্যয়ের সাথে সংগ্রামী হয়ে ওঠার স্বপ্নের সন্ধান দিয়ে গেছেন। এই মহান ব্যক্তিটি নিজের অবস্থানকে সমাসীন করেছেন জ্যোতির্ময় আলোকবর্তিকায়। যদিও সশরীরে তিনি আজ আমাদের মধ্যে উপস্থিত নেই। কিন্তু তাঁর তেজোদীপ্ত জীবনসংগ্রাম ও সাধনার আলেখ্য অনির্বাণ আলোকশিখার ন্যায় দেদীপ্যমান হয়ে আছে।

তিনি আজো চট্টগ্রামবাসীর কাণ্ডারী হয়ে জনহৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আসনে আসীন। তাঁর আদর্শ ও শিক্ষা আমাদের প্রতিনিয়ত দিক-নির্দেশনা দিয়ে চলেছে। অনন্তকাল ধরেই জনমানুষের হৃদয়ে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর কর্মের মধ্য দিয়ে। মৃত্যুবার্ষিকীতে আজ আমরা তাঁকে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি, তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

চট্টগ্রামের উন্নয়ন-আন্দোলনের পুরোধা চট্টলদরদী ইউসুফ চৌধুরীর জন্ম ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ সেপ্টেম্বর রাউজানের ঢেউয়া হাজীপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। সে সময় এ অঞ্চলে ব্রিটিশ-সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে জনগণ প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল।

স্বশাসন ও স্বাধীনতার দাবি ক্রমশ জোরদার হয়ে উঠেছিল। আর বৃটিশ-শাসন ও শোষণের নাগপাশ ছিন্ন করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশাল ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর ‘বিদ্রোহী কবিতা’ সহ বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম সাধারণ মানুষের মনে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগিয়ে তুলেছিল, যুবসমাজকে স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তাঁর মাধ্যমে ব্রিটিশ-বিরোধী জন-জাগরণের হাওয়া বাংলা জনপদসহ ভারতবর্ষের চারিদিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল।

এ জন্যে তিনি ব্রিটিশশাসকগোষ্ঠীর রোষানলেও পড়েছিলেন। তাঁকে জেলে বন্দিও করা হয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই দমানো যায়নি। আর এই চেতনাবিকাশী সময়ের ভেতর দিয়েই শৈশব পেরিয়ে ক্রমশ বিকশিত হয়েছেন মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী। শুধু তাই নয়, ছেলেবেলায় তিনি তাঁর নিজ বাড়িতেই জাগরণের কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্নেহ-সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। প্রেম-দ্রোহ ও মানবতার কবি একটি সম্মেলনে যোগ দিতে এসে হাজীবাড়িতে আতিথ্য পেয়েছিলেন। কিশোরবেলায় বিদ্রোহী কবির সেই দর্শন, তাঁর মানস গঠন ও পরবর্তী জীবনকে প্রভাবিত করেছিলো। ফলে আপন জীবন গঠনে একাগ্রতার প্রভাবে তিনি প্রত্যয়ী হতে পেরেছেন।

শিক্ষাজীবন শেষে পুস্তক ব্যবসা দিয়েই কর্মজীবনের যে সূচনা করেছিলেন তিনি, সেটি চূড়ান্ত সাফল্যের শিখরে উঠেছে দৈনিক পূর্বকোণের মতো একটি আধুনিক মানের পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে। সংবাদপত্র যে দেশ ও জনসেবার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম, তা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাই সূচনালগ্ন থেকেই তিনি দৈনিক পূর্বকোণকে সত্যিকার অর্থে জনগণের মুখপত্র হিসেবে, দেশ ও জনস্বার্থের প্রহরী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। সে চেষ্টায় তিনি পুরোপুরি সফল হয়েছেন।

আজো পূর্বকোণ জনমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে তাঁর দেখানো পথ ধরে দুর্নিবার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। দৈনিক পূর্বকোণ সুদীর্ঘ ছত্রিশ বছরের বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী হয়ে বহু প্রতিকূলতার পাহাড় ডিঙিয়ে আজও সগর্বে টিকে আছে। শুধু তা নয়, মুজিববর্ষে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল কর্তৃক আঞ্চলিকে দেশসেরা পত্রিকার স্বীকৃতি এবং মর্যাদাও পেয়েছে।

জন-আকাঙ্ক্ষার আলোকে একটি আধুনিক সংবাদপত্রের প্রকাশনার পাশাপাশি চট্টগ্রামের উন্নয়ন-আন্দোলনে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে এ অঞ্চলের জনগণের জন্য চট্টলদরদী ইউসুফ চৌধুরী দিয়ে গেছেন আলোকিত এক পথরেখা। সে পথ ধরেই আজ এগিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম।

তিনি আজো চট্টগ্রামবাসীর কাণ্ডারী হয়ে জনমানুষের হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আসনে আসীন। কর্মগুণে এই জনপদের মানুষের উন্নয়নের ইতিহাস, অর্জন ও সংগ্রামী ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছেন তিনি। চট্টগ্রামের উন্নয়ন-সংগ্রামের ইতিহাস থেকে তাঁকে বাদ দেয়া যাবে না কখনো। কারণ এই জনপদের উন্নয়ন-সমৃদ্ধি এবং ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম।

চট্টগ্রামে ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকার পাশাপাশি বিআইটিকে চুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের ধারাবাহিক সংগ্রামসহ নানাক্ষেত্রেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ওষুধশিল্পের বিকাশে তাঁর অবদান অসামান্য। বাংলাদেশের ডেইরি আন্দোলনেরও অগ্রপুরুষ ছিলেন তিনি। ডেইরি শিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনার ব্যাপারে সরকারসহ সবার দৃষ্টি কাড়তে তিনি চট্টগ্রামে প্রথম গবাদিপশু মেলার আয়োজন করেন। দেশে প্রথম তাঁর নেতৃত্বে রুগ্ন গরু নিয়ে মিছিল হয়।

যাবতীয় অন্যায়-অবিচার, অনিয়ম-দুর্নীতি, সন্ত্রাসী পেশীশক্তির অরাজকতার বিরুদ্ধে সদা সোচ্চারকণ্ঠ ছিলেন তিনি। আজ সশরীরে তিনি আমাদের মধ্যে উপস্থিত নেই। কিন্তু তাঁর আদর্শ, তাঁর মানবতাবাদী দর্শন, তাঁর মানবকল্যাণ ও উন্নয়ন-চিন্তা আমাদের সবাইকে পথ দেখাচ্ছে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, পরলোক গমনের দেড়দশক পরেও আমাদের সমাজবাস্তবতায় তিনি যেমন প্রাসঙ্গিক ও স্বমহিমায় উজ্জ্বল, তেমনি সুদূর ভবিষ্যতেও তিনি প্রাসঙ্গিক ও অমলিন হয়ে থাকবেন।

পূর্বকোণ/আর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট