মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে র্দীঘ ১২ দিনব্যাপী শ্রমিক ধর্মঘটের পর চট্টগ্রামের ২১টি চা বাগানের মধ্যে রামগড়, কৈয়াছড়া এবং নিউ দাঁতমারা বাগান ছাড়া অন্য সবগুলো বাগানে শ্রমিকরা সোমবার (গতকাল) কাজে যোগদান করেছেন। ভরা মৌসুমে শ্রমিক আন্দোলনে বাগান থেকে চা পাতা সংগ্রহ বন্ধ থাকায় গাছেই নষ্ট হয়ে গেছে প্রায় ২২৯ কোটি টাকার চা।
এছাড়া দেশের ইতিহাসে এ প্রথম এত দীর্ঘ সময় চলা শ্রমিক ধর্মঘটে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বাগানগুলোর। ফলে উৎপাদন বিপর্যয়ের শঙ্কায় রয়েছেন বাগান মালিকরা। চট্টগ্রামের ২১ টি বাগানের মধ্যে ১৭টিই ফটিকছড়িতে অবস্থিত।
৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে গত ৯ আগস্ট থেকে চট্টগ্রামের ২১টি বাগানসহ দেশের ১৬৭টি বাগানে শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হয়। ১৫ আগস্ট সরকারি বন্ধ ছাড়া ২১ আগস্ট পর্যন্ত টানা ১২দিন চলে এ ধর্মঘট। দেশে চা বাগানসমূহে উদ্ভূত শ্রম অসন্তোষ নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসানের সভাপতিত্বে রবিবার (২১ আগস্ট) রাত নয়টা থেকে সোমবার (২২ আগস্ট) মধ্যরাত পর্যন্ত চা বাগানের শ্রমিক নেতৃবৃন্দের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে শ্রমিক নেতারা প্রশাসনের সাথে পূর্বের মজুরিতে (১২০ টাকা) বাগানে ফেরার জন্য সিদ্ধান্ত নেন এবং লিখিতভাবে যৌথ বিবৃতি প্রদান করেন। এ সিদ্ধান্তের পর চট্টগ্রামের ২১ টি বাগানের মধ্যে রামগড়, কৈয়াছড়া ও নিউ দাঁতমারা ছাড়া সবগুলো বাগানের শ্রমিকরা সোমবার (গতকাল) সকালে কাজে ফিরেন।
গত ২০ আগস্ট মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলায় বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের কার্যালয়ে চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ ও সরকারের প্রতিনিধিদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নতুন মজুরি নির্ধারণ করা হয় ১৪৫ টাকা। এরপর চলমান কর্মবিরতি প্রত্যাহার করার কথা জানান চা শ্রমিক নেতারা। কিন্তু সভা থেকে বের হয়ে সাধারণ চা শ্রমিকদের রোষানলে পড়ে এই সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে আসে চা শ্রমিক ইউনিয়ন। সর্বশেষ রবিবার রাতে চা শ্রমিকদের নিয়ে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান পুনরায় বৈঠকে বসেন। এসময় চা শ্রমিকদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই চা শ্রমিকরা তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন এবং তারা কাজে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন।
এদিকে, টানা ১২ দিন শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে চট্টগ্রামের ২১টি বাগানে পাতা না ছেঁড়ায় তা আগাছার মত লম্বা হয়ে গেছে। বড় ও শক্ত হয়ে গেছে চা গাছের পাতা। পরিপক্ব হয়ে গেছে মূল কুঁড়ি। নিয়মানুযায়ী, টানা সাত দিন চা-বাগানের প্রতিটা সেকশন ঘুরে ঘুরে পাতা উত্তোলন করা হয়। এরই মধ্যে পাতা উত্তোলন কাজ অনেক পিছিয়ে পড়েছে। বাগান কর্তৃপক্ষ জানায়, চায়ের এ ভরা মৌসুমে কর্মবিরতির কারণে ২১টি বাগানে দৈনিক প্রায় ৪ লক্ষ কেজি সবুজ চা পাতা সংগ্রহ হয়নি। ফলে এ পাতা গাছেই নষ্ট হয়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ৪ কেজি ৫০০ গ্রাম সবুজ চা পাতায় এক কেজি মেইড টি বা চা তৈরি হয়। এ হিসেবে ৪ লক্ষ কেজি সবুজ চা পাতায় ৯০ হাজার কেজি মেইড টি তৈরি হয়। নিলাম বাজারের দর অনুযায়ী এক কেজি চায়ের দাম ২২০ টাকা । এ হিসেবে চট্টগ্রামের ২১ টি বাগানেই দৈনিক ১৯ কোটি ৮ লক্ষ টাকার চা নষ্ট হয়। ধর্মঘটকালীন ১২ দিনে ২১ টি বাগানে প্রায় ২২৮ কোটি ৯৬ লক্ষ টাকার চা নষ্ট হয়। এতে সরকার প্রায় ৩৪ কোটি ৩৫ লক্ষ টাকা ভ্যাট বাবত আয় হতে বঞ্চিত হল।
ফটিকছড়ির নেপচুন চা বাগানের জি এম কাজী ইরফান উল্লাহ বলেন, এবছর চট্টগ্রামে চায়ের সুপার বাম্পার উৎপাদন হয়েছিল। কিন্তু ধর্মঘটের কারণে সব শেষ। বাগানগুলো অপূরণীয় ক্ষতিগ্রস্ত হল। তিনি বলেন, ‘১২ দিন বাগান বন্ধ থাকায় গাছের পাতাগুলো অনেক বেড়ে গেছে। এগুলো আর হাতে তোলা যাবে না। এছাড়া এ পাতা দিয়ে ভালো চা হবে না। মানসম্পন্ন চা উৎপাদন করতে হলে এখন গাছের ওপরের পাতা ছেঁটে অপেক্ষা করতে হবে। নতুন কুঁড়ি এলে সেগুলো হবে চা তৈরির কাঁচামাল। তবে ততদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে গেলে মৌসুম শেষ হয়ে যাবে। তাই এ বছর চা-শিল্পে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেল’।
রামগড় চা-বাগানের সিনিয়র ব্যবস্থাপক মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি যেটি হয়েছে, সেটি হলো আমরা আমাদের পুরো প্লাকিং রাউন্ড থেকে পিছিয়ে গেছি। বিপুল পরিমাণ পাতা গাছেই নষ্ট হয়ে গেছে। পরিচর্যা বন্ধ থাকায় ক্ষতিকর পোকামাকড়ও আক্রমণ করেছে বাগানে’।
বাংলাদেশি চা সংসদের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাবেক চেয়ারম্যান মো. জাহাঙগীর আলম বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সারাদেশে একযোগে এত দীর্ঘদিন শ্রমিক ধর্মঘটের নজীর নেই। তিনি বলেন, এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চা মৌসুম গণণা করা হয়। তন্মধ্যে আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর এ তিন মাস ভরা মৌসুম। আগস্ট মাস প্রায় চলে গেল ধর্মঘটে। এ আগস্টের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতেই চা মৌসুম থাকবে না। কারণ এবার অনাবৃষ্টি ও অধিক তাপমাত্রায় আবহাওয়া প্রতিকূলে’।
চট্টগ্রাম চা শ্রমিক ইউনিয়নের চট্টগ্রাম ভ্যালীর সভাপতি নিরঞ্জন নাথ মন্টু বলেন, ‘বাংলদেশের ইতিহাসে টানা এতোদিন শ্রমিক ধর্মঘট হয়নি, এটা ঠিক। এতে চা শিল্পের বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির ন্যায়সঙ্গত দাবি জানিয়ে ৩ আগস্ট প্রথমে ৭দিনের আলটিমেটাম দেয়া হয়েছিল। পরে ৩ দিনের দুই ঘণ্টার কর্মবিরতির কর্মসূচি দেয়া হয়। এরপরও সরকার কর্ণপাত করেনি। ফলে বাধ্য হয়ে ৯ আগস্ট হতে অনিদিষ্টকালের ধর্মঘটে যেতে হয় শ্রমিকদের। শুরু থেকে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হলে চা শিল্পের এত বড় ক্ষতি হত না।’
পূর্বকোণ/আর