চট্টগ্রাম শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

‘আতুর ঘরে’ গাড়ি নির্মাণ শিল্প

১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ | ১:২৮ অপরাহ্ণ

ইফতেখারুল ইসলাম 

প্রায় ১২ যুগ আগে বিশ্বে প্রথম যে গাড়িটি রাস্তায় নামানো হয়েছিল তা দেখতে অনেকটা আমাদের ব্যাটারিচালিত রিকশার মতই। সময় যতই গড়িয়েছে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে গাড়ি শিল্পের বিপ্লব ঘটেছে। প্রতিনিয়ত নতুন মডেলের গাড়ি তৈরি করছে তারা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করার পরও বাংলাদেশে এই শিল্প এখনো ‘আতুর ঘরে’। ব্যাটারিচালিত রিকশার মতো ছোট যানবাহনও নিরাপদ বাহন হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি। অথচ দেশে প্রচুর গাড়ির ক্রেতা রয়েছে যা প্রতিবছরই বাড়ছে।

একেতো গাড়ি নির্মাণ শিল্পের কাঁচামালের খনিজ সম্পদ বাংলাদেশে নেই। দ্বিতীয়ত যেটুকু আছে তার সাথে দক্ষ জনবলকে কাজে লাগিয়ে এই শিল্পকে দেশে এগিয়ে নেয়ার অনুকূল পরিবেশও গড়ে ওঠেনি।

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এর তথ্যমতে, ২০১০ সালে বাংলাদেশে মোট গাড়ির সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ ২৭ হাজার ৩৬৮টি। ১১ বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে হয়েছে ৪৯ লাখ ৭১ হাজার ৫৩৫টি। এই সময়ে গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে প্রায় সাড়ে তিন গুণ। এর বাইরে অনিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যাও কম নয়। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে প্রতিদিন বাড়ছে গাড়ি ক্রেতার সংখ্যা ।

বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল সংলগ্ন একাধিক গ্যারেজ মালিকের সাথে আলাপকালে তারা জানান, চট্টগ্রামসহ সারাদেশের প্রায় অর্ধশতাধিক গ্যারেজে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল বাসের বডি নির্মাণ করা হয়। সুনিপুণ হাতে নির্মাণ করা হয় এসি-নন এসি বাস ও ট্রাকের বডি। অনুকূল রাষ্ট্রীয় নীতিমালা পেলে এসব গ্যারেজ থেকেই হয়তো কোন উদ্যোক্তা তৈরি হত।

নগরীর বাদুরতলার একাধিক সিএনজি ট্যাক্সি বিক্রেতার সাথে আলাপকালে তারা জানান, আমদানি নির্ভরশীলতার কারণে টিকতে পারছেন না ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। সিএনজি ট্যাক্সির বডির ৫০ রকমের পার্টস দেশেই উৎপাদন হয়। এই খাতে অনেকেই বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু আমদানি নির্ভরতার কারণে অনেক বিনিয়োগকারি নিঃস্ব হয়েছে। এমনকি দেশে বাস-ট্রাকের বডি নির্মাণ হলেও সিএনজি ট্যাক্সির বডি নির্মাণের সুযোগ নেই। কারণ ভারত থেকে পূর্ণাঙ্গ সিএনজি ট্যাক্সি আমদানি করা হয়।

পরিকল্পনাতেই প্রগতির ৫০ বছর পার : গাড়ি নির্মাণে একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান প্রগতির ৫০ বছর পার হল পরিকল্পনাতেই। ইংল্যান্ডের জেনারেল মোটরসের কারিগরি সহযোগিতায় ১৯৬৬ সালে বন্দর নগরীর ব্যক্তি মালিকানায় গাড়ি সংযোজন কারখানা হিসেবে গান্ধারা ইন্ডাস্ট্রিজ লি. প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লি. (পিআইএল) নামে জাতীয়করণ করা হয়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল কর্পোরেশনের (বিএসইসি) অধীন বাংলাদেশের গাড়ি সংযোজনকারী এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটি স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন মডেলের প্রায় ৬০ হাজার গাড়ি বিক্রি করেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর প্রগ্রেসিভ ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্টের সুবিধা সম্বলিত বছরে দুই শিফটে ৫০ হাজার গাড়ি উৎপাদন/সংযোজন সক্ষমতাসম্পন্ন সম্পূর্ণ নতুন একটি অত্যাধুনিক অটোমেটিক গাড়ি সংযোজন কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

বেসরকারি উদ্যোগে আশার সঞ্চার : বেসরকারি খাতে দেশীয় অটোমোবাইলস প্রতিষ্ঠান পিএইচপি। মালেশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. মাহাথির মোহাম্মদের হাত ধরে ছয় বছর আগে যাত্রা শুরু করে পিএইচপি অটোমোবাইলস লি.। প্রতিষ্ঠানটি মালেশিয়ার প্রোটন ব্র্যান্ডের প্রাইভেট কার দেশেই সংযোজন করছে। পিএইচপি কারখানায় দেশের সন্তানরাই গাড়ি সংযোজন থেকে রং করা সবকিছু করছে। চট্টগ্রামের কারখানাতেই ২৬টি খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে। আরো ১৫০ টি যন্ত্রাংশ তৈরির সক্ষমতা তাদের আছে।

এছাড়া মিরসরাই-সীতাকুণ্ড ও ফেনীর সোনাগাজী এলাকায় ২০১৮ সাল থেকে এখানকার একশ একর জমিতে গড়ে উঠছে বাংলাদেশ অটো ইন্ড্রাস্ট্রিজ নামে একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণ কারখানা। শুধু গাড়ি নয় তারা এখানে তৈরি করবে ব্যাটারি ও চার্জিং ইউনিট। বাংলাদেশি ব্র্যান্ডের এ গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এখানে ৭০ ভাগ যন্ত্রাংশ তৈরি করবে বাকি ৩০ ভাগ সংযোজিত হবে।

গাড়ির চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে এই শিল্প গড়ে না উঠার কারণ জানতে চাইলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ইস্ট ডেল্টা বিশ্ব বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সিকান্দর খান পূর্বকোণকে বলেন, আমরা যতখানি আমদানি নির্ভর তার থেকে যদি স্বনির্ভর হতে পারি তাহলে আমাদের অনেক লাভ হত। আমদানি ব্যয় কমে যেত। গাড়ির মত সহজে অর্থ আয়ের শিল্প খুবই কম আছে। কিছুদিন আগে শুনলাম পিএইচপি গাড়ি সংযোজন করছে। গাড়ি বানাতে গেলে একটি ট্রেডিশনও লাগে। তাছাড়া গাড়ি নির্মাণ শিল্পের জন্য যে কাঁচামাল প্রয়োজন তার খনিজ সম্পদ আমাদের নেই। এখন আমরা সংযোজন করেই এগিয়ে যেতে হবে। আমদানির উপর অধিক শুল্ক আরোপ করে সেকেন্ডারি লেভেলে এই শিল্প গড়ে তুলতে হবে। খনিজ সম্পদ না থাকার কারণেই এই শিল্পটি সেভাবে গড়ে উঠেনি। গাড়ির প্রধান উপকরণ লোহার কোন খনি আমাদের নেই। তবে অনেক গ্যারেজে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বাস-ট্রাকের বডি বানাচ্ছে। আমাদের কারিগররা অনেক ভাল। এই দক্ষতাকে কাজে লাগাতে হবে।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান পূর্বকোণকে বলেন, মূলত অনুকূল পলিসি গ্রহণ না করাই এই শিল্প বিকাশের বড় বাধা। অথচ আমাদের দেশে গাড়ির বিশাল বাজার রয়েছে। যার চাহিদা আমদানি করে মেটানো হচ্ছে।  একইসময়ে ভারত জয়েনভেঞ্চারে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে এসে তাদের শিল্পের প্রসার ঘটাচ্ছে। একদিকে তাদের গাড়ির চাহিদা মেটাচ্ছে। অপরদিকে তাদের আমদানি ব্যয় কমে যাচ্ছে। সেই পলিসি আমাদেরও নেয়া উচিত। তাতে আমাদের আমদানি ব্যয়ও কমে যেত।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট