চট্টগ্রাম রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

মহিষের দইয়ে ক্ষতিকর ছত্রাক

ইমাম হোসাইন রাজু 

৯ জানুয়ারি, ২০২২ | ১২:৩১ অপরাহ্ণ

ইমাম হোসাইন রাজু 

দেশে মহিষের দইয়ে পাওয়া গেছে অণুজীব ও ছত্রাকের উপস্থিতি। যা মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গে সহজেই সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম। এমন সব অনুজীব ও ছত্রাক শরীরের সাত ধরণের রোগের কারণ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের গবেষণায় এমন তথ্যই ওঠে এসেছে।

গবেষকরা দেশের বাজারে পাওয়া যায় এমন ১০ ব্র্যান্ডের দইয়ে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের উপস্থিতি এবং পুষ্টিগুণ শনাক্ত করেন। গবেষণায় গরুর টক দই ও মিষ্টি দই এবং মহিষের টক দই মিলিয়ে মোট ৩০৬ রকমের ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত হয়। এরমধ্যে ২৮ রকমের ব্যাকটেরিয়া সবগুলো দইয়েই পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন গবেষকগণ। দইয়ে বাকটেরিয়া ও ছত্রাক একসাথে চিহ্নিতকরণের এরকম গবেষণা এটিই বাংলাদেশে প্রথম বলে দাবি করেন গবেষকরা।

ইতোমধ্যে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে নেচার গ্রুপের “সায়েন্টিফিক রিপোর্টস” শীর্ষক নিবন্ধে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বিসিএসআইআর, বন গবেষণাগার, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার গবেষকদের যৌথ এ গবেষণায় নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক এস এম রফিকুল ইসলাম। গবেষণায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ, রংপুর, মুন্সিগঞ্জ ও বগুড়ার বিভিন্ন স্থান থেকে পর পর তিনমাসে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সংগ্রহ করা বিভিন্ন দই নিয়ে এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়।

গবেষণায় ওঠে আসে, মহিষের দই-এ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ছত্রাক থাকার বিষয়টি। যাতে আছে ক্যান্ডিডা, আয়োডোফেনাস, এপিওট্রাইকাম ও ট্রাইকোস্পোরন জাতীয় ছত্রাক। এই ছত্রাকগুলো চুলকানি ও চামড়ায় সংক্রমণ, হজমে সমস্যা এবং রক্তে বিষক্রিয়ার জন্য মারাত্মকভাবে দায়ী। এছাড়া নগণ্য পরিমাণে ল্যাক্টোব্যাসিলাস এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণে এন্টারোব্যাকটার, এসিনেটোব্যাক্টার, শিগেলা, ক্লেবসিয়েলা, সাইট্রোব্যাক্টার ও এরোমোনাস

প্রজাতির অণুজীব পাওয়া যায় তাতে। যা মানবদেহের বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী হতে পারে বলে মনে করেন গবেষকরা। এরমধ্যে পাকস্থলীর সংক্রমণ, ডায়রিয়া ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এদেরমধ্যে এন্টারোব্যাকটার প্রজাতির অণুজীব সাধারণত গবাদিপশুর মলমূত্রে পাওয়া যায়, যা এসব প্রাণীর অন্ত্র সংক্রমণের জন্য দায়ী।

গবেষকেরা মনে করেন মহিষের দইয়ের লবণাক্ত এবং ভিন্ন মাত্রার স্বাদ অবিকৃত রাখার জন্য দুধ থেকে দই প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় তা পর্যাপ্ত পরিমাণে ফোটানো হয় না। যার ফলে এসব দইয়ে সংক্রামক অণুজীবের উপস্থিতি বাড়িয়ে দিচ্ছে।

২০১৯ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া এই গবেষণা প্রকল্প সমাপ্ত হয় ২০২১ সালের আগস্ট মাসে। বাজারের শীর্ষস্থানীয় টক এবং মিষ্টি দইয়ের ব্র্যান্ডগুলোতে এন্টিবায়োটিক, আর্সেনিক বা ভারী ধাতব পদার্থ তেমন উল্লেখযোগ্যভাবে পাওয়া যায়নি এই গবেষণায়।

প্রধান গবেষক অধ্যাপক এস এম রফিকুল ইসলাম বলেন, এটি দইয়ের নিরাপদ খাদ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দেয়। দেশে যেহেতু খুব বেশি মহিষের দই বিএসটিআই অনুমোদিত নেই, তাই একটিমাত্র জনপ্রিয় মহিষের দইয়ের নমুনা চট্টগ্রাম থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, যা প্রাথমিকভাবে মহিষের দইয়ের মাঝে বিভিন্ন অণুজীবের উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য বিশ্লেষণ করা হয়। তবে দেশের মহিষের দইয়ের পূর্ণাঙ্গ চিত্র বুঝতে সবগুলো প্রচলিত মহিষের দই নিয়ে গবেষকদলের কাজ করার পরিকল্পনা আছে। এই গবেষণার পরবর্তী ধাপে গবেষকগণ ২৫টি ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের দই নিয়ে কাজ করার লক্ষ্য আছে বলে জানান তিনি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক ও সহ-গবেষক আদনান মান্নান বলেন, এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল তিনটি- আমাদের দেশের বিভিন্ন দইয়ের মধ্যে পুষ্টিগুণের তুলনা, ভারী ধাতব ও এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি যাচাই করে দেখা এবং বিভিন্ন অণুজীবের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি শনাক্তকরণ। সামগ্রিকভাবে দেশীয় দইয়ের খাদ্য নিরাপত্তার মান কেমন, তা যাচাই দেখা ছিল মোটা দাগে এই গবেষণার লক্ষ্য।

গবেষণায় ওঠে আসে, তুলনামূলকভাবে মিষ্টি দইয়ে উপকারী অণুজীবের পরিমাণ কম এবং কয়েকটি ব্র্যান্ডে স্ট্রেপটোকক্কাস অণুজীবের পাশাপাশি ক্ল্যাভিসপোরা প্রজাতির ছত্রাকের বিপুল পরিমাণে উপস্থিতি পাওয়া গেছে এ গবেষণায়। এর পেছনে অতিরিক্ত চিনি বা অন্যান্য দ্রব্য মেশানো একটি কারণ হতে পারে বলে মনে করেন গবেষকেরা। ক্ল্যাভিসপোরা অতিরিক্ত চিনির উপস্থিতিতে বসবাস করতে পারে। এটি সরাসরি কোন রোগের জন্য মারাত্মকভাবে দায়ী না হলেও খাবারকে তাড়াতাড়ি পচিয়ে ফেলতে এর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। এ গবেষণায় আরও দেখা যায়, পুষ্টিগুণের দিক থেকে টক দই অনেক বেশি এগিয়ে। টক দইয়ে উপকারি খনিজ সোডিয়াম, পটাশিয়াম এবং ক্যালসিয়ামের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি পাওয়া গেছে। কিন্তু বেশ কিছু ব্রান্ডসহ অধিকাংশ মিষ্টি দইয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মানবদেহের গঠন, বিকাশ ও প্রজননের সাহায্য করা ‘জিঙ্ক’ পাওয়া যায়নি।

যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র নির্দেশনা অনুযায়ী, দইয়ে ক্ষেত্রে ৮-১১ মিলিগ্রাম/কেজি জিঙ্ক থাকতে হবে। কিন্তু দেশীয় দইগুলোর ৭০ শতাংশ ব্র্যান্ডে তা পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়নি। আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী দইয়ে ভিটামিন, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, কপার, আয়োডিন, ফসফরাস, আয়রন, জিঙ্কের উপস্থিতি দইয়ের পুষ্টিগুণ নিশ্চিত করে। দেশের কয়েকটি টক দইয়ের ব্র্যান্ডে এর সবগুলো উপাদানই পাওয়া গেছে। কিন্তু বেশ কিছু দই বিশেষত মিষ্টি দইয়ে পুষ্টি উপাদান তুলনামূলকভাবে কম পাওয়া গেছে, যাতে দইয়ে আকাক্সিক্ষত পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি আছে বলে মনে হয় বলেও উল্লেখ করেন গবেষকরা।

গবেষণায় অন্যদের মধ্যে যুক্ত ছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার মার্শাল সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিজের গবেষক আলফ্রেড চ্যান এবং কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মোহাম্মদ জাভেদ ফয়সাল। গবেষকদলে ডেইরি বিশেষজ্ঞ হিসেবে ছিলেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অধ্যাপক জুনায়েদ সিদ্দিকি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক ড. মো. নাজমুল হক। এছাড়াও বাংলাদেশ ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট চট্টগ্রামের গবেষক মোহাম্মদ জাকির হোসেন, বিসিএসআইআর চট্টগ্রামের বিজ্ঞানী গোলাম মোস্তফা ও আবু বক্কর সিদ্দিক। গবেষণাগারে পুরো কাজটি সম্পাদন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আফসানা ইয়াসমিন তানজিনা ও মেহেদী হাসান রুমি।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট