চট্টগ্রাম শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪

স্বপ্নই থেকে গেল পরিকল্পিত নগরী

ইমরান বিন ছবুর

২৯ ডিসেম্বর, ২০২১ | ১২:৪৫ অপরাহ্ণ

চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী বলা হলেও চট্টগ্রামবাসীর জীবনমানে নেই তার ছোঁয়া। নগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, যোগাযোগ অবকাঠামো ও পরিকল্পিত নগরায়ন নিয়ে একের পর এক প্রকল্প নেওয়া হলেও সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবে খুব বেশি সুফল আসেনি। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও পরিকল্পিত নগরী গড়ে না উঠা অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মনে করছেন চট্টগ্রামের নগর পরিকল্পনাবিদরা। অপরিকল্পিত কাজের ফল সরূপ ২০২১ সালে এসেও ড্রেন-নালা ও খালে পড়ে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সূত্রে জানা যায়, সিডিএ প্রতিষ্ঠার ১৯৬১ সালে প্রথম চট্টগ্রামের জন্য প্রথম মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরপর নব্বইয়ের দশকে ‘প্রিপারেশন অব স্ট্রাকচার মাস্টার প্ল্যান এন্ড ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান ১৯৯৫’ নামে চট্টগ্রাম শহরের জন্য মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করে সিডিএ। যা বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয় ১৯৯৫ হতে ২০১৫ পর্যন্ত। প্রকল্প বাস্তবায়নকাল তিন ধাপে ভাগ করা হয়- স্বল্পমেয়াদী ১৯৯৫ হতে ২০০০, মাঝারিমেয়াদি ২০০০ হতে ২০০৫ এবং দীর্ঘমেয়াদি ২০০৫ হতে ২০১৫। কিন্তু কোনো পরিকল্পনাই যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনি সিডিএ।
সংশ্লিষ্টেেদর মতে, পরিকল্পিত নগর বলতে বুঝায় একটি পরিকল্পিত জনবসতি। যার সবকিছু হবে পরিকল্পনা অনুযায়ী। কোথায় স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল হবে, অফিস-আদালত কোথায়, কোথায় বসবাসের জায়গা সবকিছুই হবে পরিকল্পনামাফিক। পরিকল্পনামাফিক সবকিছু হলে প্রত্যেক নগরেই মানুষ শৃঙ্খলাপূর্ণ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু এই নগরই আবার পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠলে তাতে নাগরিকদের জীবন অস্বস্তিকর হয়ে উঠে। আমাদের পরিকল্পনা হয় বিশ্বমানের, কিন্তু তার বাস্তবায়ন আমরা দেখতে পাই না বলে অভিযোগ স্থপতি আশিক ইমরানের।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সিডিএ’র বোর্ড সদস্য ও স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, পরিকল্পিত নগরী করার জন্য সিডিএ’র তো একটি মাস্টারপ্ল্যান ছিল। সেই মাস্টারপ্ল্যানের মেয়াদ শেষ হয় ২০১৮ সালে। বিভিন্ন কারণে ওই মাস্টারপ্ল্যান সিডিএ বাস্তবায়ন করতে পারেনি বা বাস্তবায়ন করা হয়নি। মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন না করার পেছনে সিডিএ যেমন দায়ী, একইভাবে আমরা নাগরিকরাও দায়ী।
তিনি আরো বলেন, আইন না মানা কিংবা আইন পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি আমাদের রয়েছে। একটি শহরের মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের জন্য সিডিএকে যে সহযোগিতা করা প্রয়োজন তা আমরা করিনি। সিডিএ’র সমস্যা হচ্ছে, মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের জন্য যথাযথভাবে আইনের প্রয়োগ এবং তদারকি করেনি বা করতে পারেনি। সিডিএ’রও জনবল সংকটসহ বেশকিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এছাড়া, প্রভাবশালীদের চাপ রয়েছে। তাদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক চাপের কারণে অনেক সময় কাজ করা যায় না।
সিডিএ নতুন মাস্টারপ্ল্যানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সিডিএ নতুন মাস্টারপ্ল্যান করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আমরা আশা করবো, বর্তমানে নগরীতে যেসব সমস্যা রয়েছে সেসব সমস্যা মাথায় রেখে মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করবে। মাস্টারপ্ল্যান করা এক জিনিস, আর বাস্তবায়ন করা ভিন্ন জিনিস। আমাদের পরিকল্পনা হয় বিশ^মানের, কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয় না।
পার্কিং এর জায়গা না রেখে ভবন নির্মাণ করা হয় উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, প্ল্যান নেওয়ার সময় সব ভবনে পার্কিং দেখিয়ে অনুমোদন নেওয়ার হয়। কিন্ত ভবন নির্মাণের সময় পার্কিং এর জায়গা রাখেন না অধিকাংশ ভবন মালিক। পার্কিং এর জায়গায় হয় ফ্ল্যাট না হয় দোকান নির্মাণ করে ভাড়া দেওয়া হয়। যার ফলে নগরীতে যানজট বৃদ্ধি পাচ্ছে। এগুলো সিডিএ খুব একটা তদারকি করে না। অনেক এসব অনিয়মের পিছনে অসাধু কর্মকর্তারা জড়িত থাকেন। সবকিছু মিলিয়ে চট্টগ্রাম একটি অচল শহরে পরিণত হচ্ছে। যা আমাদের জন্য একদিকে যেমন ক্ষোভের, একইসাথে হতাশারও।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক প্রফেসর শারমিন আরা বলেন, নগরীর উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন সময়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু সুষ্ঠুভাবে এবং সময়মত তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যারা উন্নয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট তাদের সুদীর্ঘ পরিকল্পনার অভাব সবচেয়ে বড় সমস্যা। আরেকটি প্রধান সমস্যা হচ্ছে সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। যেটা ছাড়া কোন শহরকে পরিকল্পিত নগরে রূপান্তর করা যাবে না।
তিনি আরো বলেন, কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে তা তদারকি করা হয় না বলে অনিয়মগুলো থেকে যায়। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার পাশাপাশি চাহিদাভিত্তিক পরিকল্পনাগুলোকে সমন্বয় করতে হবে।
সিডিএ’র প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, চট্টগ্রামকে আধুনিক নগরী করার জন্য ২০ বছর মেয়াদি নতুন মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এই মহাপরিকল্পনার আওতায় পুরো নগরীর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটি বিশদ সমীক্ষা হবে। সেই সমীক্ষার ভিত্তিতে অনুযায়ী তৈরি হবে ২০২১ থেকে ২০৪১ সালের ২০ বছরের নতুন মহাপরিকল্পনা বলেও জানান তিনি।

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট